ক্ষুদ্র আশাবাদ
পৃথিবী থেকে মানব সম্প্রদায় ধ্বংস হয়ে যাবে। আর সেটা ঘটবে আমাদের ধারণাকৃত সময়ের অনেক আগেই। পিছিয়ে পড়া তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে আমরা আরো আগে ধ্বংস হব। প্রাকৃতিক বিপর্যয় তো আছেই, কিন্তু আমাদের ধ্বংসের জন্য প্রকৃতির দিকে চেয়ে থাকতে হবে না, মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের কারণেই আমরা আগেভাগে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো। অবশ্য বিপর্যয়ের বাকি তেমন কিছু নেই। আর একজন ব্যক্তি হিসেবে আপনি বা আমি এর পরিবর্তনের জন্য কিছুই করতে পারবো না। কোন কিছুতে কোন পরিবর্তন আনতে পারবো না। বিভিন্ন এক্টিভিজমের মাধ্যমে নিজেদের সান্ত্বনা দিতে পারবো এই ভেবে যে আমি অনেক কিছু করে ফেলছি, কিন্তু আসলে ফলাফল শূন্য।
প্রকৃতির যে বারোটা আমরা বাজিয়ে রেখেছি সারা বিশ্ব জুড়ে, সেটার অবস্থা এখন এমন যে, চাইলেও আর পিছিয়ে আসা সম্ভব না। এর নিয়ন্ত্রণ আর আমাদের হাতে নেই। উন্নত বিশ্বের দেশ গুলো হয়তো তুলনামূলক বেশি সময় ধরে টিকে থাকবে তাদের উন্নত নাগরিক ব্যবস্থাদির কারণে। কিন্তু আমাদের মত দেশ গুলোর পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হবে। মানবসৃষ্ট বিপর্যয় আর অব্যবস্থাপনা আমাদের ধ্বংস তরাণ্বিত করবে।
আমাদের কোন প্রতিষ্ঠান ঠিক নেই। কোন মানুষ ঠিক নেই। এ অবস্থায় যখন কেউ কিছু ঠিক করতে যায় বা নিজে ঠিক হতে যায় তখন দেখা যায় পরিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে সে কিছুই করতে পারেনা, উলটো বিপদাপন্ন হয়। তখন একজন মানুষের কী করার থাকে? তার সামনে তখন দুটি রাস্তা- ১. বোকার মত পরিবর্তনের চেষ্টা করে যাওয়া অথবা ২. বিদ্যমান অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া। বেসিক ইন্সটিংক্ট থেকে বেশিরভাগ মানুষ দ্বিতীয় পথটি বেছে নেয়, যদি না খুব বেশি নির্বোধ না হয়ে থাকে।
এমতাবস্থায় আমাদের লেখালেখি, প্রতিবাদ, বিচার বিশ্লেষণ একেবারেই গুরুত্বহীন। আমি এক সময় চলমান বিভিন্ন বিষয়ে লিখতাম, নিজের মতামত দিতে চাইতাম, বিশ্লেষণ করতাম নিজের মত করে। কিছু মানুষের সেগুলো ভালোও লাগতো। তাদের মধ্যেই কয়েকজন সেসব লেখা দেখতে চায় এখনো। কিন্তু আমি এখন কী করি, কিছু লিখতে গিয়ে নিজেকে কয়েকটা প্রশ্ন করি- এই লেখার ফলে কি সমস্যার সমাধান হবার কোন সম্ভাবনা আছে? এই লেখা দেখে বিপরীত চিন্তাভাবনার কারো কি পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে? এই লেখার কি কোন রকমের কোন মূল্য আছে? অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রশ্ন গুলোর উত্তর হয় - না। ফলে আর সেটা লেখা হয় না।
এখন আমি আমার পঠিত বই গুলো নিয়ে আরো বেশি লেখার চেষ্টা করি, ব্যক্তিগত কথাবার্তা লেখার চেষ্টা করি। নিজের সময়টা উপভোগ করাটাই এখন বড় ব্যাপার বলে মনে হয়। যারা ফেসবুকে খাবারদাবার, খেলাধুলা, মুভি সিনেমা ইত্যাদি নিয়ে লেখে তাদের লেখা আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, সাম্প্রতিক সমস্যা নিয়ে সুচিন্তিত মতামত গুলোর থেকে। যারা এসব নিয়ে লেখে তারা নিজেদের মত করে জীবন উপভোগ করছে। সমস্যা গুলোর সমাধান সে করতে পারবে না জেনেই অবচেতনে বা সচেতন ভাবে সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অন্যদিকে সুচিন্তিত মতামত প্রদানকারী বিশেষজ্ঞ সম্প্রদায় নিজেদের মত করে চেষ্টা করছে সমস্যা সমাধানের, যেখানে শেষ পর্যন্ত কোন লাভ নেই। আমিও এদের দলেই ছিলাম, হয়তো এখনো আছি, কিন্তু এর থেকে নিজের ক্ষুদ্র জীবনে প্রাপ্ত স্বল্প সময়টুকু নিজের মত করে উপভোগ করাটাই আমার কাছে এখন বেশি লজিকাল বলে মনে হয়। অনেকে আমার এই চিন্তাকে ভোগবাদী দর্শনের সাথে মেলাতে পারেন অথবা বলতে পারেন আমি চূড়ান্ত হতাশাবাদের প্রচার করছি। কিন্তু আমার স্বল্প বুদ্ধির ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে এর থেকে ভালো কোন চিন্তা আপাতত কাজ করছে না।
আশাবাদ ভালো। আশা না থাকলে প্রগতির পথ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু এখন কি উল্টোটা হচ্ছে না? প্রগতি বন্ধ হয়ে গেছে বলেই কি আমরা আশা করতে ভয় পাচ্ছি? যারা আশাবাদী তারা নিজেদের এবং অন্যদের বোকা বানানোর চেষ্টা করে হয়তো নিজেদের অজান্তেই। তারপরেও তাদের চিন্তার প্রতি সম্মান রইলো। অন্তিম মুহুর্তেও এই আশাবাদ, আমাদের যন্ত্রণা কিছুটা হলেও লাঘব করতে সাহায্য করে, করবে।
মানুষ ধ্বংস হয়ে যাবে কিন্তু মহাবিশ্ব টিকে থাকবে আরো দীর্ঘ সময়। সেই শান্ত মহাবিশ্বের সাথে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণিকা হয়ে টিকে থাকবো আমি, আমার কাছে এটুকুই একমাত্র আশাবাদের জায়গা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন