প্রেতে ও মানুষে। পর্ব-৪(শেষ পর্ব)

ফুঁসতে লাগল মালতী। সে ভাবল, নিশ্চয়ই তার মতো কেউ নরেনের কাছে এসছিল। মালতী বলল, " তুমি আমার সঙ্গে প্রবঞ্চনা করছ না তো? তুমি আমায় ছুঁয়ে বল আমি আগে একবার এসেছিলাম?"
নরেন সঙ্গে সঙ্গে তাই করলে। মালতী আর কোন কথা না বলে এক মনে ভাবতে লাগল। মালতীরর মুখের সোন্দর্য গেছে মিলিয়ে, মুখ রাগে কালো হয়ে গেছে আর থমথম করছে। কিছুক্ষণ পর মালতী নরেনকে বললে যে এর আগে সে আসেনি। অন্য কেউ তার মতো সেজে এসেছিল।
নরেন যেন কত দু:খ আর ভয় পেয়েছে এইভাবে বলল, " যদি তাই হয়ে থাকে তবে তুমি আমায় তার হাত থেকে বাঁচাও, আমার তোমাকেই ভালো লাগে আর তোমারই বন্ধুত্ব কামনা করি। যদি কেউ এভাবে আসে তাহলে আমি আর বাঁচব না, যে করে হোক তুমি আমায় এই ঘোর বিপদ থেকে বাঁচাও"।
মালতী কিছুক্ষণ গভীরভাবে চিন্তা করে বলল, " এর এক উপায় আছে কিন্তু তা কি তুমি পারবে? আমায় সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারবে? আমি কে তা তো জান, এই গভীর রাত্রে আমার সঙ্গে তুমি এক জায়গায় যেতে পার?"
নরেন বুঝল এতক্ষণে তার জীবনের সবচেয়ে সঙ্কটময় সময় উপস্থিত হয়েছে, তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এল এবং বুকের ভেতর কেমন করতে লাগল। সে কষ্টে হেসে বললে, " তোমার সঙ্গে যাব তাতে ভয়টা কি? কিন্তু তুমি কি করতে চাও বুঝিয়ে বল।"
মালতী বললে, " এখান থেকে দু মাইল উত্তরে যে জঙ্গলটা আছে সেখানে তোমায় নিয়ে যাব। সেখানে এক জায়গায় এক রকম লতা আছে সেই লতার শেকড় তোমায় আনতে হবে"।
নরেন বললে, " তা তুমি কেন নিজেই নিয়ে এস না, তুমি তো সব জায়গায় যেতে পার, বাইরে কি ভীষণ মেঘ করেছে দেখ, তুমি তো জানো, আমার হাঁটতে এখন কত কষ্ট হয়"।
মালতী বললে, " আমি যদি আনতে পারতাম তাহলে তোমায় কষ্ট দিই? আমি সে লতা গাছের কাছেও যেতে পারি না। তোমাকেই সেই শেকড় আনতে হবে। সেই শেকড় দিনরাত তোমার হাতে বেঁধে রাখতে হবে। ঠিক রাত বারোটায় সেই শেকড় খুলে অন্য ঘরে তফাত করে রেখে আসবে, আর রাত দুটোয় আমি চলে গেলে আবার পরে থাকবে, তাহলে কেউ তোমার কাছে আসতে পারবে না"।
নরেন আর কিছু বলল না এবং তারা দুজন ঘর থেকে উঠোনে নামল, ক্রমে উঠোনের বাইরে এসে গ্রামের উত্তর দিকে যেতে লাগল। আকাশ গভীর মেঘাচ্ছন্ন, থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, পল্লী পথ জনহীন, নরেনের সঙ্গে কেবল মালতী।
সে মানুষ নয়, তা নরেন জানে। শুধু তাই নয় নরেন দূর্বল বলে মালতী তার হাত ধরে আছে। মালতী তাকে বললে, " এখন তুমি বেশী পরিশ্রম করো না, তুমি আমার কাঁধে ভর দিয়ে চল, মনে রেখ, আসবার সময় আমি তোমার কাছে থাকতে পারবে না, তোমায় নিজেকেই আসতে হবে"।
এইভাবে তারা দুজনে যাচ্ছে, গ্রাম্যপথ ছেড়ে তারা ধানক্ষেতের দিকে গেল এবং সরু আলের ওপর দিয়ে যেতে লাগল। গভীর অন্ধকারের মধ্যে মধ্যে বিদ্যুতের আলোয় নরেন পথ দেখতে পাচ্ছে, অন্য সময় সম্পূর্ণ মালতীর ওপর নির্ভরশীল। ক্রমে তারা নদীর ধারে পৌঁছল, সামনেই শ্মশান, যার নাম কালাপেড়ের দেয়াড়।
কটি তেঁতুল গাছ দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে। নির্জন স্থান। নরেনের বুক সবলে স্পন্দিত হতে লাগল, কিন্তু ওঝার কথা তখন তার কানে বাজছে, " নরেন, তোমার জীবন তোমার হাতে, ভূতনাথকে স্মরণ করবে, কোনও ভয় নেই"।
এইবার জঙ্গল আরম্ভ হল, এখন আর পথ নেই, প্রেতিনী যেখানে নিয়ে যাচ্ছে, মানুষ সেদিকে যাচ্ছে। একটু পরে ডানদিকে একটা বড় অশ্বত্থ গাছ দেখা গেল। মালতী নরেনকে ছেড়ে দিয়ে বললে, " ওই গাছটার ওপারে আগাছার জঙ্গল আছে। সেখানে গোটাকতক লতানে গাছ আছে, তারই একটা শেকড়সুদ্ধ তুলে নিয়ে এসো, তোমায় একলাই যেতে হবে"।
প্রেতিনীর নির্দেশমতো নরেন সেদিকে এগিয়ে গেল এবং সেখানে কয়েকটা লতানে গাছ দেখতে পেল। মূলসুদ্ধ একটা লতানে গাছ তুলে এনে নরেন পূর্বস্থানে এসে মালতীকে আর সেখানে দেখতে পেল না। সভয়ে ডাকল, " মালতী "!
প্রায় পঞ্চাশ হাত দূর থেকে মালতী জবাব দিল, " আমি এখানে। এখন তো মেঘ কিছুটা কেটে গেছে, অল্প চাঁদের আলো ফুটেছে, আমার সাদা কাপড় তো তুমি দেখতে পারছ, আমি এগিয়ে যাচ্ছি, তুমি পেছন পেছন এস"।
নরেন দ্রুতপদে মালতীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, " আগে তুমি শেকড়টা দেখ তো ঠিক জিনিস এনেছি কিনা"।
মালতী সঙ্গে সঙ্গে দূরে সরে যেতে যেতে বলল, " হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক জিনিসই এনেছ, তুমি আমার অত কাছে এসো না"।
মালতী এগিয়ে যাচ্ছে আর পঞ্চাশ হাত পিছু পিছু নরেন আসছে। আবার সেই নদীর ধার.....সেই কালাপেড়ের দেয়াড়। সেই ধানক্ষেত, সেই সরু আলের রাস্তা। আবছা আলোয় নরেন মালতীকে দেখতে পারছে। ক্রমে গ্রাম্যপথে এসে অবশেষে বাড়ি।
মালতী চেঁচিয়ে বললে, " তুমি শেকড়টা অন্য ঘরে রেখে এস। এখনো দুটো বাজতে আধ ঘন্টা দেরী আছে"।
নরেনের ওঝার কথা মনে পড়ল, " পরিত্রাণের উপায় পেলে এক মূহুর্তের জন্য তা ত্যাগ করবে না".....তাই নরেন বললে, " আজ আমি বড় ক্লান্ত, আজ যাও, কাল এস"।
মালতী বললে, " বেশ তাই হোক। এখনি শেকড়টা হাতে বেঁধে ফেল, কাল রাত বারোটার সময় আবার খুলে রেখ"।
নরেন বাড়িতে পৌঁছেই জমিদারবাড়ির বৈঠকখানায় গেল। সেখানে ওঝা, জমিদারবাবু, নরেনের বাবা গভীর দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে বসেছিলেন। নরেনকে দেখে তাঁরা আনন্দে কলরব করে উঠলেন। ওঝা জিজ্ঞাসা করলে, " ওষুধ পেয়েছ? কি জিনিস পেলে দেখি?"
নরেন শেকড়সুদ্ধ লতাটি ওঝাকে দেখিয়ে মালতী তাকে যা যা বলেছে সব বলল।
ওঝা বললে, " আর ভয় নেই। জয় ভোলানাথ।"
সেই রাত্রেই এক বালার ভেতর সেই শেকড় রেখে নরেনের বাহুতে মোক্ষম করে বেঁধে দেওয়া হল। সে এমন বজ্র বাঁধন যে নরেন শত চেষ্টা করলেও অন্যের সাহায্য ছাড়া সেটি খুলতে পারবে না। এই বালা ওঝাই সঙ্গে এনেছিল আর এর গঠনও বিশেষ ধরনের।
নরেনকে বালা পরিয়ে রোজা বলল, " এখন দিনকতক ও রোজ রাত্রে আসবে। অনুনয় বিনয় করবে এমনকি ভয়ও দেখাবে। কিন্তু এই বালাই তোমার ইষ্ট কবচ। সে যাই বলুক আর যাই করুক, তুমি প্রাণান্তেও এই বালা খোলার চেষ্টা করবে না"।
ওঝা যা বলেছিল তাই হল। পরদিন রাতে নরেন দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে আর মালতী ঘরের বাইরে থেকে তাকে শেকড়টা খুলে ফেলার জন্য অনুনয় করছে। আজ আর সে বন্ধ দরজার মধ্যে দিয়ে ঘরে আসতে পারল না। নরেন মালতীর কথার কোনও জবাব দিল না। প্রথম দু তিন রাত অনুনয় বিনয় চলল তারপর ভয় প্রদর্শন,
"আমার কথা না শুনলে আমি তোমার প্রাণ নেব, কেউ তোমায় বাঁচাতে পারবে না"।
নরেন তবু নিরুত্তর। এই উপদ্রব আট দশদিন চলেছিল, তারপর মালতী আর আসে নি। নরেন তার বাবার সাথে গ্রামে ফিরে গেল এবং মা বাবার আদর যত্নে শীগগিরই সে দৈহিক আর মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠল।
নরেনের আনন্দ, তার মা বাবার আনন্দ, জমিদার ও তাঁর পরিবারবর্গের আনন্দ, পাড়া প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজনদের আনন্দ আর সর্বোপরি আনন্দ হচ্ছে ওঝার। শুধু যে সে একটা অমূল্য জীবন রক্ষা করেছে তাই নয় সকলের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছে।

-----সমাপ্ত-----

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রাক্ষসী। পর্ব-১

পথযুবক

প্রথম প্রেমপত্র