রাক্ষসী। পর্ব-১

এই কংক্রিট শহরের বুকে ঠিকমতো আকাশেরই দেখা মেলে না, জোছনার দর্শন কী করে মিলবে? তবু আকাশে চোখ রেখে ব্যাপারটা অনুভব করার চেষ্টা করে রাশেদ। ভীষণ উজ্জ্বল রুপালি চাঁদটা ঠিক মাথার ওপরে। ঠিক এখনই যদি নিভে যেত এই সড়কটার সবগুলো স্ট্রিট ল্যাম্প, মার্কেটগুলোর রঙিন আলো আর যানবাহনের হেডলাইট—তা হলে হয়তো জোছনা অবতরণ করতে পারত নগরীর বুকে। দেখতে দেখতে পিচঢালা সড়কটা হয়ে যেত রুপালি ছায়াপথ।

অবশ্য স্বপ্নই দেখা যেতে পারে শুধু। মস্ত বড় এই শহরে লাখো স্বপ্ন যেমন ভাঙে প্রতিদিন, তেমনি পূরণও হয়। কিন্তু জোছনায় ভেজার স্বপ্নপূরণের ক্ষমতা যে এই নগরীরও নেই।
ক্লান্ত, অবসন্ন, বিষণ্ণ রাশেদ একা একা হাঁটে বাড়ির পথে। কেন যেন আজকাল মনের শরীরে সরীসৃপের মতো বিষণ্ণতা জড়িয়ে থাকে সবসময়। দিন শেষে বাড়ি না ফেরার আগ পর্যন্ত কিছুতেই পিছু ছাড়ে না। আজব সব ইচ্ছা জাগে মনে, যার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারা যায় না। অদ্ভুত সব ব্যাপারে মন অকারণ আগ্রহী হয়ে ওঠে...

বাড়ি এসে গেছে। দরোজায় দাঁড়ানো আয়শার মুখটা দেখামাত্র আজেবাজে ভাবনা নিমিষে উড়ে যায় মন থেকে। কী ভীষণ মিষ্টি একটা মুখ। টলটলে চোখ জোড়ার দিকে তাকানো মাত্র বুকের মাঝে বর্ষা নামে, ছড়িয়ে পড়ে স্নিগ্ধ প্রশান্তির কণা।
সত্যি কথা বলতে কী, আয়শার মতো স্বচ্ছ মনের মানুষ খুব বেশি দেখা যায় না। সোজা-সরল, নির্লোভ, নিরহংকার একজন মানুষ। আশপাশে সবাই যখন যুগের তীব্র গতির সাথে তাল মেলাতে ব্যস্ত, আয়শা তখন ডুবে আছে নিজের ভিন্ন জগতে। কলুষতাবিহীন, অন্যরকম একটা জগৎ। মানুষ প্রাণীটাকে ভীষণ ভালবাসে সে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কিংবা পাড়া-পড়শী—সকলের জন্যই তার খুব টান।
আলতো করে হাসে আয়শা। হাত থেকে বাজারের ব্যাগগুলো নিয়ে দরোজা বন্ধ করে।
‘তোমার অফিস এত কাজ করায় কেন বলো তো?’
‘হঠাৎ এ কথা?’
‘আজও ফিরতে দেরি হলো তোমার!’
হেসে ফেলল রাশেদ। ‘শুধু অফিসকে দোষ দিচ্ছ কেন? এমনও তো হতে পারে অন্য কোথাও ছিলাম আমি। হয়তো কোনও সুন্দরীর সাথে...’
‘ইস অত সোজা? তুমি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালবাসতে পারোই না।’
‘এত বিশ্বাস করা ভাল না, ম্যাডাম!... রোকসানা কই?’
‘ঘুমাচ্ছে। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি খাবার দিচ্ছি টেবিলে।’
আয়শা চলে যায় কিচেনে। বাথরুমে ঢোকার আগে রোকসানার ঘরের দিকে একবার উঁকি দেয় রাশেদ। এ কদিনেই মেয়েটার চেহারা একদম ফিরে গেছে। স্বাস্থ্য ভাল হয়েছে। মুখটায় ফিরে এসেছে শিশুসুলভ স্বাভাবিক চাপল্য।

এই আরেকটা ব্যাপার আয়শার। আশ্চর্য সুন্দর। রাস্তা থেকে এতিম ছেলে-মেয়ে বাড়ি নিয়ে আসে সে। বলে যে কাজের লোক হিসেবে নিয়ে এলাম। কিন্তু আসলে কাজ করানোর চাইতে আদরই করে বেশি। ওসব ছেলে-পিলেরা অবশ্য কেউ-ই বেশি দিন থাকে না। রাস্তায় রাস্তায় বেড়ে ওঠা ছেলে-পিলেদের মন কি আর চার দেয়ালের মাঝে টেকে? কিছুদিন ভালমন্দ খেয়ে, নতুন কিছু জামাকাপড় পেলেই পালায় এরা।
যাওয়ার আগে চুরি-চামারিও করে বোধ হয়। তবে সেটা নিয়ে আয়শা কখনও উচ্চবাচ্য করে না। এবং হালও ছাড়ে না। আবার একজনকে খুঁজে নিয়ে আসে। এবং আশা করে এইবারের জন হয়তো তাকে ছেড়ে যাবে না। হয়তো!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাশেদ।
বিধাতা তাদের একটি সন্তান কেন দিচ্ছেন না? বিয়ের পর একে একে পাঁচটা বছর পার হয়ে গেছে। এখন তো আয়শা এ ব্যাপারে কথা পর্যন্ত বলে না। বোঝাই যায়, আশা করাও ছেড়ে দিয়েছে। এবং এ-ও বোঝা যায় যে রাস্তার অনাথ শিশুগুলোকে ভালবেসে মাতৃত্বের অতৃপ্ত সাধটাই পূরণ করার চেষ্টা করে সে।
ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি হয়েছে বিস্তর। দুজনের কারোরই কোন সমস্যা নেই। কিন্তু...
এই একটা কিন্তুই নীরব সমস্যা হয়ে জেগে আছে পাথুরে দ্বীপের মতন, রাশেদ-আয়শার দাম্পত্যের প্রশান্ত নীল সমুদ্রে!
সম্ভবত আজীবনই থাকবে।
খিদে পেয়েছে সাংঘাতিক। আয়শা কোথায়? ও হ্যাঁ, মার্কেটে।
নিজেই এসে ফ্রিজ খোলে রাশেদ। সে রকম কিছু নেই, পাঁউরুটি আর কোল্ড ড্রিংকস ছাড়া। আয়শা ফ্রিজে রাখা খাবার কখনও রাশেদের সামনে আনে না। স্বামীর পছন্দ নয়, জানা আছে তার।
একটা প্লেটে কয়েক স্লাইস ভাজা মাংস দেখা যাচ্ছে। কী করা যায়? স্যান্ডউইচ করা যেতে পারে...হ্যাঁ, সেটাই সহজ। দু স্লাইস রুটিতে পুর করে মেয়োনিজ মাখিয়ে কয়েক স্লাইস মাংস, একটু সিদ্ধ ডিম, একটা লেটুসপাতা আর অল্প গোলমরিচ। ব্যস, রেডি টু ইট!
উমমম! দারুণ!
নিজের প্রতিভায় নিজেই বিস্মিত হয় রাশেদ। রান্না করাটা তা হলে খুব বেশি একটা কঠিন কিছু নয়। চাইলেই শেখা যেতে পারে। ইচ্ছা থাকতে হবে।
‘তুমি এটা কী খাচ্ছ?’ স্যান্ডউইচটা হাতে দেখে রীতিমতো চিৎকার করে ওঠে আয়শা। ‘দেখি! আমাকে দেখাও!’
‘আরে, একটা স্যান্ডউইচ তো। ফ্রিজে যে মাংসের স্লাইস ছিল...’
‘সেই মাংস দিয়ে বানিয়েছ? হায়, খোদা! ফেলে দাও। এক্ষুনি ফেলে দাও। এক্ষুনি!’
নিজেই স্যান্ডউইচটা ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে আয়শা।
‘কী হলো?’ বিস্মিত রাশেদ। ‘সমস্যা কী?’

‘ওই মাংস খাওয়া যাবে না। অনেক দিনের পুরনো। আমি তোমাকে অন্য কিছু করে দিচ্ছি।’
‘অনেক দিনের পুরনো তো ফেলে দাওনি কেন?’
‘ভুলে গেছি।’ উদ্বিগ্ন দেখায় আয়শাকে। ‘তুমি কতটুকু খেয়েছ ঠিক করে বলো তো?'
‘বেশি না। ৩/৪ কামড় দিয়েছি।’
এবার একটু হাসল আয়শা। ‘ডায়রিয়া হলে কিন্তু আমার দোষ নেই।’
‘নাহ্। এত সামান্যে কারও শরীর খারাপ হয় না।’
‘হতেই পারে। মানুষেরই তো শরীর...’
আয়শার কথাই অবশ্য ঠিক হয়েছে। সত্যিই রাতে শরীরটা বেশ খারাপ হয়েছিল। ডায়রিয়া হয়নি, তবে বমি-টমি করে যাচ্ছেতাই অবস্থা। দু’দিন অফিস কামাই হয়েছিল।

ঘটনাটা বেশ আগের। ৬/৭ দিন তো হবেই। রোকসানাকে যেদিন প্রথম বেড়াতে নিয়ে গেল আয়শা, সেদিনকার ঘটনা। শরীর ভাল হয়ে গেলেও বোধহয় মনটা হয়নি। সেদিনের পর থেকে খাবার টেবিলে বসলেই কেমন যেন অনীহা লাগে। কখনও কখনও বমি পায়। অথচ পেটে রাক্ষুসে খিদে। পুরানো, বাসি মাংস ছিল। না জানি কত রকম জীবাণু বাসা বেঁধে ছিল...
‘তুমি আবার ওইসব হাবিজাবি ভাবছ?’
একটু বিব্রতই বোধহয় হলো রাশেদ। প্রসঙ্গ বদলানোর জন্যে বলে, ‘তুমি তো দেখছি কিছুই খাচ্ছ না। এতকিছু আমি একা খাব নাকি?’
‘আমি কোন কালে বেশি খেতাম?’
‘এত অল্প খেয়ে তুমি বেঁচে থাকো কী করে—সেটাই আশ্চর্যের বিষয়।’
কথাটা অবশ্য সত্যি। আয়শা প্রায় কিছুই খায় না। যেন অনেকটা নিয়ম রক্ষার জন্যেই খাবার টেবিলে বসে। ভাত-ডাল-সবজির মতো স্বাভাবিক সব খাবারে তার ভীষণ অনীহা।
প্রিয় হচ্ছে কোল্ড ড্রিংকস, চকোলেট আর কালো কফি। প্রিয় বললেও ভুল হবে। এই তিনটা আয়শার প্রধান খাদ্য।
‘তুমি এটা একটু ট্রাই করে দেখো তো!’ ফ্রিজ থেকে ছোট্ট একটা বাটি বের করে দেয় আয়শা। ‘একটু খেয়ে দেখো। মনে হয় ভাল লাগবে। কদিন যাবৎ তো একদম না খেয়ে আছ।’
খাবারটা এমন আহামরি কিছু না। ছোট ছোট মাংসের টুকরা। মশলায় কালো রঙ হয়ে গেছে। রঙ আর গন্ধ—দুটোই আচারের মতো।
‘এটা তো আচার মনে হচ্ছে।’
‘আচার-মাংস বলে একে। তুমি একটু খেয়েই দেখো না। ভাল লাগবে।’
সত্যিই তাই। ভীষণ ভাল লাগে রাশেদের। অনেকদিন পর আরাম করে খেতে পারে সে। মন ভরে, পেটপুরে। মাংসটা কাঁচা না রান্না করা, সে নিয়ে মোটেও মাথা ঘামায় না।
একটু লক্ষ করলেই রাশেদ দেখতে পেত যে তার স্ত্রীর চোখে ভর করেছে অন্য রকম আলো। কীসের যেন সংকেত দুচোখের সেই আলোয়!

চলবে....

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পথযুবক

প্রথম প্রেমপত্র