শিল্পীর স্বাধীনতা

যে কোন বদ্ধ সমাজে নতুন আইডিয়া কখনোই গৃহীত হয়না। গৃহীত হওয়া পরের কথা, জন্মই হয়না। নতুন আইডিয়া বা ফরমের জন্ম দিতে গেলে যে মানসিক চর্চার দরকার হয় সেই চর্চার সুযোগ বদ্ধ সমাজে অনুপস্থিত। শিল্পী, সাহিত্যিক এবং সৃজনশীল মানুষের কাজ হচ্ছে জনতাকে ধাক্কা দেয়া। ধাক্কা দিয়ে দিয়ে তার চিন্তার ক্ষেত্র প্রশস্ত করা, তাকে মানসিক চর্চা করতে বাধ্য করা।

কেবল জনতার মনোরঞ্জনের জন্য শিল্প সাহিত্য সিনেমা তৈরি হলে সেটাকে সৃজনশীলতা না বলে কপিবাজী বলাই ভালো। যদি জনতার অনুভূতির কথা ভেবে তাদেরকে তাদের রুচি অনুযায়ী জিনিস সাপ্লাই দেয়া হয়, তবে জনতার রুচির উন্নতিও হবে না, শিল্প সাহিত্যে প্রগতিও আসবে না- এক স্থানে জমাট বেধে থাকবে। অথচ সংস্কৃতি বদ্ধ পুকুর নয়,বহমান নদী। জনতাকে, তাদের রুচিকে অর্থাৎ প্রথাকে অতিক্রম করে কিছু করতে না পারলে সংস্কৃতি বদ্ধ পুকুর হয়েই থাকবে। আর কে না জানে, বদ্ধ পুকুরেই শ্যাওলা জন্মায়, পচে গলে দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে। অর্থাৎ বদ্ধ পুকুরের মত সংস্কৃতি কোন সুস্থ সংস্কৃতি নয়। রুগ্ন ও দুর্বল সংস্কৃতি। যার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতি বা আরো ভালো করে বলতে গেলে এই বাংলার 'মুসলিম বাঙালি ' সংস্কৃতি।

কাজেই যখন কোন শিল্পী বা সাহিত্যিক বা যে কোন সৃজনশীল মানুষ নিজের ভিতর সমাজকে ধাক্কা দেয়ার এই তাড়না অনুভব করে, তখন স্বাভাবিক ভাবেই সে বেছে নিতে চাইবে সেই অংশটা যেখানে আঘাত করলে পুকুরের পানিতে সবচে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি হবে, যেখানে আঘাত করলে ওলোটপালোট হবে সবথেকে বেশি। তো ররক্ষণশীল বাঙালি মুসলিম সমাজে সবথেকে স্পর্শ কাতর জায়গা কোনটি? আমার কাছে এরকম সবথেকে স্পর্শকাতর এমন দুটি জায়গা হল- যৌনতা এবং অবশ্যই ধর্ম।

পশ্চিমবাংলার সাথে এই বাংলার সাংস্কৃতিক অনেক মিল থাকলেও, ওদের কালচারাল ম্যাচিওরিটি আমাদের থেকে অনেক অনেক বেশি। ওদের বিভিন্ন আলোচনা, আড্ডা গুলো যখন শুনি তখন দেখি, ওরা কাজ করতে গিয়ে যেসব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে, সেগুলো নিয়ে যে কাজ করা যায়- এটাই আমরা এখনো ভাবতে পারিনা। আলোচনা করাতো দূরের ব্যাপার। সেই পশ্চিমবাংলা এই ম্যাচিওরিটি অর্জন করেছে এরকম বহু সৃজনশীল মানুষের আঘাতে। সেই মানুষ গুলোকে যে সমসাময়িক সমাজ বিনাপ্রশ্নে মেনে নিয়েছে তাতো নয়, তাদের নানা রকম বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে- জেল জরিমানা হুমকি ধামকি কিছুই বাদ যায়নি। সেই বিদ্যাসাগর মহাশয় যখন বিধবাবিবাহের পক্ষে বলেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ তখন হৈহৈ করে উঠেছে। কিন্তু তিনি আঘাত দিয়েছিলেন বলেই আজ বিধবাবিবাহ সেখানে স্বাভাবিক ব্যাপার। সে সময় যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুভূতিতে আঘাত লাগার অযুহাতে বিধবাবিবাহের আইন পাশ না হত, তবে এই উত্তরণ হয়তো আরো দেরিতে আসতো। অর্থাৎ কাউকে না কাউকে ধাক্কাটা দিতেই হবে।

সমকালীন সময়ের একটা উদাহরণ দেয়া যায়। ভারতে সমকামীদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এই ঘটনা কিন্তু একদিনে ঘটেনি। সেখানকার সাহিত্য চলচ্চিত্র এই ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। মূলধারার অনেক চলচ্চিত্রে হাস্যরসাত্মক ভাবে অনেক সময় উপস্থাপন করা হলেও, অনেক সিরিয়াস কাজও হয়েছে। সমাজ কিন্তু বিনাপ্রশ্নে মেনে নেয়নি বা প্রথমেই গ্রহণও করে নেয়নি। সেজন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হয়েছে, আর এই কাজটি করেছেন সেখানকার সৃজনশীল কালচারড মানুষেরা। আমাদের এখানেও সমকামীদের অধিকার আদায়ে কাজ হয়েছে খুবই অল্প পরিসরে। কিন্তু ফলাফল? দুজন এক্টিভিস্টকে কুপিয়ে হত্যা। পার্থক্যটা হচ্ছে এই এক্সট্রিমিজমে। সমাজের পছন্দ না হলে সমাজ যে শুধু সমালোচনা বা গালাগাল করবে তা নয়- একেবারে মেরে ফেলে রেখে যাবে! কার ঘাড়ে দুটো মাথা যে আবার ধাক্কা দিতে যাবে সমাজকে?

আমাদের এখানে নিয়ম না মানা তরুণপ্রজন্ম তাদের আক্রমণের বিষয় হিসেবে যে ধর্মকে বেছে নিয়েছিল তার কারণ ছিল এই এক্সট্রিমিজম। এই এক্সট্রিমিজম যেহেতু প্রগতির অন্য পথ গুলোকে রুদ্ধ করে দিচ্ছে তাহলে আগে এটাকেই আঘাত করা যাক। আঘাত খেতে খেতে মানুষের সয়ে যাক, তারা 'এই হারামজাদা আমার ধর্ম নিয়ে কটু কথা বলছে, একে ধরে কোপানো দরকার' - এই প্যারাডাইম থেকে - ' এই হারামজাদা আমার ধর্ম নিয়ে কটু কথা বলছে, এর লেখা আর পড়বোই না, দিলাম ব্লক করে'- এই প্যারাডাইমে আসুক। তারপর না হয় এক সময়, 'এই লোক ধর্ম নিয়ে এই কথা বলছে, একটু ভেবে দেখি ব্যাপারটা'- এই প্যারাডাইমে তারা আসবে।

অথচ সরকারের নিঃস্পৃহতা আর সংখ্যাগরিষ্ঠের মৌন সমর্থনের জোরে অবর্ণনীয় নৃশংসতার সাথে এই তরুণদের হত্যা করা হল। ফলে এই আঘাত দেয়ার কাজটা, সেটা যুক্তি দিয়ে হোক বা অন্য কোনভাবে হোক- করার জন্য আর কেউ এগিয়ে আসার সাহস করলোনা। তবে আমার কাছে এই সময়টাকে একটা কালচারাল রেভ্যুলেশন বলে মনে হয়। যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে গেছেন শিখা গোষ্ঠী, আরজ আলী মাতুব্বর, আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ প্রমুখ। বহু বহু বছর পর যখন এদেশের সংস্কৃতির ইতিহাস লেখা হবে তখন এই ব্লগ কেন্দ্রীক পরিবর্তনের এই চেষ্টাকে সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। যারা নিজেদের প্রাণ দিয়ে মুক্তচিন্তার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে গেছে, তাদের স্মরণ করা হবে শ্রদ্ধার সাথে।

একজন শিল্পী বা লেখকের যা ইচ্ছা তাই সৃষ্টির স্বাধীনতা দিতে হবে। শিল্পকে কোন গণ্ডির মধ্যে বাধা যায়না। সেটাকে সমালোচনা করা, গ্রহণ বা বাতিল করার অধিকার সবার আছে। সেটা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হলেই তো সেটি সার্থক। আলোচনার মাধ্যমেই তো চিন্তার অচলায়তন কাটবে। কিন্তু তুমি এটা করতে পারবা না, এটা এভাবে করতে হবে, সেটা করলে তোকে মেরে ফেলবো- এগুলো যদি বহাল থাকে তবে সেখানে মানসিক উন্নতি সম্ভব নয়।

সৃজনশীল মানুষ মাত্রই তাড়না অনুভব করবে নতুন কিছু করার, ফলে সে সংখ্যাগরিষ্ঠের অস্বস্তির জায়গায় হাত দিতে চাইবে তার কাজের প্রয়োজনে। আর সে সময় সমাজের জিঘাংসার হাত থেকে তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব সভ্য সরকারের। কিন্তু সরকার যখন ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সেই সংখ্যাগরিষ্ঠের মনোরঞ্জনের উপরেই নির্ভরশীল তখন ক্ষমতায় থাকতে অমন দু তিনজন শিল্পী লেখকের টুটি চেপে ধরতে সরকার দুবার ভাববে না। ফলে সৃষ্টি হবে বাকস্বাধীনতা পরিপন্থী নানা আইন।

আমরা এই দেশে আসলে একটা দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়ে গেছি। ফলে বদ্ধ পুকুর থেকে নদীতে তো যেতে পারছিইনা, এমনকি পুকুরটা পরিষ্কারও করতে পারছিনা। এমন সময় সৃজনশীল মানুষ গুলো যদি প্রচণ্ড পরিমাণ সাহসী না হন, বারবার তারা আমাদের অস্বস্তির জায়গা গুলোতে আঘাত না করেন, তবে চিরকাল মজা পুকুরের পচা পানি পান করেই রুগ্ন অবস্থায় ধুকে ধুকে আমাদের বাঁচতে হবে। বিশ্ব দরবারে আপাঙতেয় এবং গুরুত্বহীন অবস্থাতেই বাঙালি বিশেষ করে বাংলাদেশি বাঙালিদের বাকি জীবন কাটাতে হবে ভ্রান্ত আত্মতুষ্টি নিয়ে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রাক্ষসী। পর্ব-১

পথযুবক

প্রথম প্রেমপত্র