রাক্ষসী। পর্ব-৩(শেষ পর্ব)
খুব সন্তর্পণে ঘটে ব্যাপারটা। বুঝি বাতাসও কিছু আঁচ করতে পারে না।
শরীরের নিবিড় সান্নিধ্যে ছিল আয়শা, নিঃশ্বাসের একান্তে। গভীর রাতের বুকে ভালবাসার গল্প বুনে যাচ্ছিল দুটো শরীর। সরব নীরবতায়...
যেন হঠাৎই বদলে যায় আয়শার অপরূপ মুখটা। হিংস্র থেকে হিংস্রতর হয়...
যেন... যেন মানুষের মুখটা বদলে হয়ে যায় কোনও জানোয়ারের মুখ। কোন পিশাচের মুখ। কোনও... কোনও প্রেতের চেহারা!
প্রাণীটা উঠে বসে বুকের ওপরে... দম বন্ধ হয়ে আসে... একটুখানি অক্সিজেনের আকাঙ্ক্ষায় আঁকুপাঁকু করে জোড়া ফুসফুস...
লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসে রাশেদ।
উফ!!!
কী ছিল ওটা? স্বপ্ন? স্বপ্ন এত ভয়াবহ রকমের বাস্তব হতে পারে?
এখনও আফ্রিকান ড্রাম বাজিয়ে যাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা। ঘামে ভিজে উঠেছে পুরো শরীর, কাঁপছে একটু একটু। এত ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন এ জীবনে অন্তত আর দেখা হয়নি।
আয়শা? আয়শা কোথায়? বোধ হয় রোকসানাকে দেখতে গেছে...
‘আমাকে এক গ্লাস পানি দিয়ে যাও না প্লিজ!’ গলা উঁচিয়ে স্ত্রীকে অনুরোধ করে রাশেদ। আবার শুয়ে পড়ে বিছানায়। মনটা ভীষণ দুর্বল লাগছে।
ভূতের ওঝার প্রভাব ভালই হয়েছে দেখা যাচ্ছে। আজেবাজে স্বপ্ন দেখছে মন...
আয়শা এল না কেন?... বোধহয় টয়লেটে। অগত্যা পানির আকাঙ্ক্ষায় নিজেকেই উঠতে হয়। ইচ্ছে করে না, পা দুটো চলতে চায় না। তবু উঠতে হয়।
বেডরুমের পর ড্রইংরুম। মাঝে সরু প্যাসেজ পার হয়ে খাবার ঘর। যাবার পথে রোকসানার ঘরে একবার উঁকি দেয় রাশেদ। নাহ্, আয়শা নেই। রোকসানাও না। কোথায় গেল মেয়েটা। কী একটা দেখে ভয় পেয়েছিল। ভয়ের কারণেই জ্বরটা এসেছে। অন্তত জ্বরের ঘোরে মেয়েটার প্রলাপ শুনে সেটাই মনে হয়েছে। ছোট মানুষ। ভয় পেতেই পারে।
কিন্তু এখন কোথায় গেল?
ডাইনিং হলেও কেউ নেই। গ্লাসে পানি ঢালে রাশেদ। ঠাণ্ডা পানি খেতে ইচ্ছে করছে। বরফ কোথায়?
কোথায় আবার, অবশ্যই ডিপফ্রিজে। নিজের আহাম্মকিতে নিজেরই হাসি পায়। আসলে আয়শা তার এত খেয়াল রাখে যে, এক গ্লাস পানিও কখনও নিজে ঢেলে খেতে হয় না।
প্রথমে ব্যাপারটা লক্ষই করে না। বরফ বের করে পরক্ষণেই আবার খোলে...
হায় খোদা!!!
হৃৎপিণ্ডটা যেন গলার কাছে এসে আটকে যায় পলিথিনে জড়ানো বস্তুটা দেখে। বস্তু নয়, একটা মাথা। মানুষের ছিন্ন মস্তক! মুখটাকেও চিনতে পারে রাশেদ। রোকসানার আগে যে ছেলেটা ছিল। সোহাগ নাম।
কিন্তু...কিন্তু আয়শা যে বলেছিল চুরি করে পালিয়ে গেছে সোহাগ...
উফ!!!
মাথাটা এলোমেলো লাগছে। মেঝের উপরই বসে রাশেদ। সোহাগের মাথাটা থেকে কিছুতেই চোখ সরাতে পারছে না। ছেলেটার লম্বা চুলে জমাট বেঁধে আছে শুভ্র বরফ কণা...
কী করে আয়শা এদের? খেয়ে ফেলে? সেটাই হবে, না হলে বাকি শরীরটা কোথায়?
তা হলে... তা হলে ভুল করে সেদিন মানুষের মাংস খেয়ে ফেলেছিল সে? আর তারপর থেকে...
তার মানে সেদিনকার সেই আচার-মাংস নামের বস্তুটা ছিল আসলে মানুষের মাংস? এই...এই সোহাগের মাংস?
কেঁদে ফেলে রাশেদ।
কল্পনা-সীমার অনেক ঊর্ধ্বের কোন আতঙ্কে মানুষ এ ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারে।
আয়শা নামের পিশাচটার সামনে সে তো ভীষণ তুচ্ছ এক মানুষ! স্রেফ একজন রক্ত-মাংসের মানুষ।
ছাদের দরোজাটা বন্ধ। তবু রাশেদ নিশ্চিত, আয়শা ছাদেই আছে। অন্য কোথাও নয়।
ওদের ফ্ল্যাটটা পাঁচ তলায়, তারপরেই ছাদ। ছোট্ট একটা কামরা আছে ছাদে, বাড়িওয়ালাকে এটার জন্য আলাদা করে এক হাজার টাকা দিতে হয়। বাচ্চাদের খেলার ঘর বানাবে বলে আয়শা অনেক জোড়াজুড়ি করে ঘরটা ভাড়া নেবার ব্যবস্থা করেছিল।
আস্তে ধাক্কা দিতেই খুলে যায় ছাদের দরোজাটা। পায়ে পায়ে সামনে এগোয় রাশেদ। খেলার ঘরে আলো জ্বলছে। আর মন বলছে ভীষণ অশুভ কিছু অপেক্ষায় আছে চার দেয়ালের ওই ইটের খাঁচায়।
ভয় হচ্ছে?
হ্যাঁ, হচ্ছে। কিন্তু তার চাইতেও অনেক বেশি তীব্র রোকসানাকে রক্ষা করার ব্যাকুল ইচ্ছাটা। ছ-সাত বছরের বাচ্চা মেয়েটা কিছুতেই কোন পিশাচের খাদ্য হতে পারে না। কিছুতেই না!
রাশেদ জানত তাকে ভীষণ কুৎসিত কিছু দেখতে হবে। তবু হাট করে খোলা দরোজার ওপাশে যে দৃশ্য দেখতে পায়, সেটা হার মানাতে বাধ্য কল্পনাকে...
হ্যাঁ, খেলার ঘরই। রঙিন দেয়াল, কার্পেটময় ছড়ানো খেলনা, ছবি আঁকার খাতা, রঙ পেন্সিল... আর সবকিছুর মাঝে সস্তা প্লাস্টিকে মুড়ে ফেলে রাখা রোকসানার শরীরটা।
মরে গেছে?
না, এখনও নয়। তবে আর বেশি দেরিও বুঝি নেই। পা জোড়া বাঁধা জানালার সাথে, মুখে আটকানো চওড়া স্কচটেপ। ঝরঝর করে অশ্রু গড়াচ্ছে দুচোখ বেয়ে। আর হাত... ডান হাতটা কেটে নেয়া হয়েছে কনুই বরাবর। ঠিক কেটে নয়, যেন ছিঁড়ে নেয়া হয়েছে। যন্ত্রণায় কাটা মুরগির মতো শরীর মোচড়াচ্ছে বাচ্চা মেয়েটা।
আর আয়শা?
কার্পেটের উপরই বসে আছে পিশাচটা। কী শান্ত, স্থির ভঙ্গি! হাতে একটা প্লেট, পাশে রাখা পেপসির ক্যান। ভীষণ আয়েশী ভঙ্গিতে রোকসানার ছিঁড়ে নেয়া হাতটা চিবুচ্ছে সে, যেন কোন মুরগির রান।
হ্যাঁ, রোকসানার হাতটাই খাচ্ছে সে। রক্ত যাতে শাড়িতে না লাগে সেজন্য কোলের উপর বিছানো ন্যাপকিন। একটু পরপর পেপসির ক্যানে চুমুক দিচ্ছে আর মিষ্টি করে হাসছে রোকসানার দিকে তাকিয়ে।
‘...ভয় পেয়ো না, সোনা সোনামণি! আর একটু কষ্ট করো। প্লিজ!... কী করব বলো। তোমার যেমন খিদে পায়, আমারও তো পায়। তুমি খাও ভাত মাংস, আর আমি খাই তোমাকে। এটাই তো পৃথিবীর নিয়ম, তাই না?... একদম চিন্তা করো না তুমি। আমি খুব সুন্দরভাবে পিস পিস করে কাটব তোমাকে। রানের মাংসগুলো রাখব বিরিয়ানি রান্নার জন্য, আঙুলগুলো নিয়ে হবে ফিঙ্গার ফ্রাই। মগজটা দিয়ে যে কত ভাল ভুনা তৈরি করতে পারি আমি, তুমি ভাবতেও পারবে না...’
রাশেদকে দেখে মোটেও ব্যস্ত হয় না আয়শা। মোহনীয় হেসে কাছে ডাকে, ‘খুব ভাল হয়েছে, তুমি এসেছ। একবার খেয়ে দেখো, তোমার সমস্ত অসুখ ভাল হয়ে যাবে। বমি পাবে না, মাথা ঘুরবে না...’
সেই হাসির সম্মোহনে সত্যিই কাছে যায় রাশেদ, ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। আর গভীর চুম্বনে তাকে আরও বেশি সম্মোহন করে আয়শা। রাশেদের জিভ পায় আয়শার ঠোঁটে লেগে থাকা রক্তের আস্বাদ। যেন ঝনঝন করে ওঠে শরীরের সমস্ত রক্তকণিকারা... তীব্র সেই স্বাদে!
খাওয়া ভুলে রাশেদের আরও ঘনিষ্ঠ হয় আয়শা। প্রচণ্ড শারীরিক আবেগে ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হয়। সম্মোহিত রাশেদও ভুলে যায় পারিপার্শ্বিকের কথা, রোকসানার কথা। কামনায় অস্থির নগ্ন দুটো শরীর মিলিত হয় রোকসানার পড়ে থাকা দেহটার পাশেই। শুধু এক মুহূর্তের জন্য ....
এক মুহূর্তের জন্য শুধু রাশেদের দৃষ্টি আটকায় বাচ্চা মেয়েটার মুখের দিকে, অবহেলায় পড়ে থাকা মাংস কাটার চাপাতির দিকে। সেদিকেই ধীরে ধীরে হাতটা বাড়ায় সে...
ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে আয়শার দুভাগ হয়ে যাওয়া গলা থেকে, রাশেদের মুখটা মাখামাখি হয়ে যায়। তার শরীরের নিচে আয়শার নগ্ন শরীরটা তখনও উত্তপ্ত, দৃষ্টিতে ফুটে আছে তখনও উগ্র কামনা।
সেদিকে আর দ্বিতীয়বার তাকায় না রাশেদ। দ্রুত পোশাক পরে রোকাসানার দেহটাকে কোলে তুলে নেয়। যে করেই হোক বাঁচাতে হবে একে। এই মেয়েটাই তাকে আইনের হাত থেকে রক্ষা করার একমাত্র হাতিয়ার।
এখনও জ্ঞান হারায়নি রোকসানা। আশা হয় রাশেদের, হয়তো বেঁচে যাবে!
খোদা করুন, যেন তাই হয়!
পরিশিষ্ট
কয়েক মাস পর ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যায় সবকিছুই।
রোকসানার সাক্ষ্য আইনের যন্ত্রণা থেকে খুব সহজভাবেই রক্ষা করে রাশেদকে। আয়শার ক্ষতও আস্তে আস্তে মন থেকে মুছে যেতে শুরু করে। ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি হৈচৈ হয় না বলে মানুষের কৌতূহলের বিষয়বস্তু হতে হয় না। এদেশে আজকাল বোধ হয় আজব আজব সংবাদের কোনও অভাব নেই।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচে রাশেদ।
প্রাণপণ চেষ্টা করে জীবনকে আবার স্বাভাবিক পথে ফিরিয়ে আনতে।
রোকসানা মেয়েটার যাবার কোন জায়গা নেই বলে সে-ও রয়ে যায় রাশেদের সাথেই। অভিশপ্ত বাড়িটাও বদল করা হয়। একটা ছুটা কাজের বুয়া রাখা হয়। রোকসানাকে দেয়া হয় স্কুলে। মেয়েটা তাকে ‘বাবা’ ‘বাবা’ ডাকে।
তবু জীবন যে আর কিছুতেই ফিরে আসে না আগের পথে!
গভীর রাতে ঘুম ভেঙে উঠে বসে থাকে রাশেদ। পেটে প্রচণ্ড খিদে। মনটা ভয়াবহ পিপাসার্ত। শরীর-মন ক্ষুধার্ত জানোয়ারের মতো হয়ে ওঠে এক টুকরো সজীব মাংসের জন্য। বারবার মনে পড়ে পাশের রুমে ঘুমিয়ে থাকা রোকসানার কথা...
...কচি কচি আঙুলগুলো চিবাতে কী মজাটাই না লাগবে। মড়মড় করে শব্দ হবে... তারপর ঘাড়ের কাছে মাংসের স্তর...
মুখ বেয়ে লালা গড়াচ্ছে রাশেদের।
অন্ধকারে জ্বলজ্বল করতে থাকে চোখজোড়া। আদিম শ্বাপদের মতো।
-----সমাপ্ত-----
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন