রাক্ষসী। পর্ব-২
অফিসে আজকাল একদম ভাল লাগে না। একটুও মন বসে না কাজে। শরীর খারাপ লাগলে কারই বা কাজ করতে ইচ্ছা হয়?
‘তোর চেহারার কী হাল হয়েছে দেখেছিস?’ কোমল কণ্ঠে বলে সুমন। বন্ধু, কলিগ। ‘আমার মনে হয় ক’টা দিন ছুটি নে। বাসায় শুয়ে-বসে থাক। অথবা ভাবীকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যা।’
‘কী লাভ? এত ডাক্তার দেখালাম, কেউ তো কোনও শারীরিক সমস্যা খুঁজে বের করতে পারে না। বলে—সমস্যা আপনার মনে।’
‘আমি জানি না। আমার কিছু খেতে ভাল লাগে না। খাবার দেখলেই বমি পায়। কোনরকম চা-কফি খেয়ে বেঁচে আছি।’
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল সুমন। তারপর বলে, ‘মানসিক চিকিৎসক দেখিয়েছিস?’
‘হুঁ। তবে লাভ কী? একগাদা ঘুমের ওষুধ দিল শুধু।’
‘ভাবী কী বলে?’
‘তোর ভাবী তো সারাদিন কান্নাকাটি করে। নিজেকে দোষ দেয়। বলে, সে বেখেয়ালে বলেই নাকি পঁচা মাংসগুলো ফ্রিজে রয়ে গেছিল।’
‘বেচারী! এমনটা ভাবতেই পারে। তোকে যা ভালবাসে! কপাল নিয়ে এসেছিলি দুনিয়ায়।’
‘আর কপাল! আজকাল মনে হয় আয়েশাকে একা ফেলে মরে-টরে না যাই '
‘যা ব্যাটা, আজেবাজে কথা বলিস না। সবকিছুই তো করে দেখলি, এখন আমার সাথে এক জায়গায় যাবি?’
‘কোথায়?’
‘গেলেই দেখতে পাবি। সন্ধ্যায় যাব। অফিসের পর।’
ঠিক সন্ধ্যায় নয়, অফিস থেকে বেরোতে বেরোতে আটটা বেজে যায়। তবু সুমন নাছোড়বান্দা। ঠিকই রাশেদকে ধরে নিয়ে যায় সে। এমন একটা জায়গা, যেখানে প্রবেশের কথা চিন্তাও করতে পারে না রাশেদ।
সরু, নোংরা গলি। দুপাশে ছাপড়া ঘর। ডাস্টবিনের উৎকট গন্ধ বস্তির সর্বত্র। প্যাঁচপেঁচে কাদা গলিতে। হাঁটতে গেলে জুতো দেবে যায়।
যে ঘরে লোকটার দেখা মেলে, তারও বাইরের অবস্থা একই রকম।
আর ভেতরে প্রবেশ করতেই সম্পূর্ণ অন্য পৃথিবী। মোটা কার্পেট পাতা মেঝেতে। বিবর্ণ, পুরানো। সিলিংয়ে ঝোলানো পুরানো ঝাড়বাতিও ছড়াচ্ছে ম্লান আলো। এছাড়া ঘরটিতে আসবাব বলতে শেলফের পর শেলফ ভরা বই আর ঝাড়বাতির নিচে পাতা সেগুন কাঠের চওড়া টেবিলটা। যার অপর প্রান্তে বসা বৃদ্ধও সাজসজ্জার মতোই প্রাচীন।
‘আসসালামু ওয়ালাইকুম, বাবারা।’ ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে বলেন তিনি। ইশারায় বসার ইঙ্গিত করেন।
সুমনের সাথে বৃদ্ধের সৌজন্য বিনিময়সূচক কথা হয় কিছু সময়। রাশেদকে নিয়েও কথাবার্তা হয় বিস্তর। কিন্তু কিছুই পৌঁছায় না রাশেদের মস্তিষ্ক পর্যন্ত। নিজেকে কেমন জড় পদার্থের মতো লাগে।
একসময় রাশেদের দুটো হাত ধরেন বৃদ্ধ। আর হাত দুটো ধরে ঝিম মেরে বসে থাকেন দীর্ঘসময়। ঘরের কোথায় যেন ধূপ জ্বেলে দিয়ে গেছে একজন। কী যে জঘন্য লাগছে গন্ধটা!
‘তোমার বাসার মানুষদের মধ্যে একজন আছে...’
কথা শেষ করতে পারেন না বৃদ্ধ। তার আগেই সুমন বলে ওঠে, ‘ওর বাসায় আর মানুষ কই! স্রেফ ও আর ভাবী।’
‘আর কেউ নেই?’ এবারও রাশেদকেই প্রশ্ন করেন তিনি।
‘আছে। একটা মেয়ে আছে এখন। রোকসানা।’ ক্ষীণ সুরে বলে রাশেদ। ‘আমরা নিঃসন্তান। মাঝে মধ্যেই আমার স্ত্রী রাস্তার ছেলেমেয়েদের নিজের কাছে এনে রাখে। ভীষণ ভালবাসে তাদের। ওদের নিয়েই আয়শার দিন কাটে।’
‘তোমার কিছু খেতে ভাল লাগে না, তাই না?’
‘সেদিন সেই পচা মাংস খাওয়ার পর থেকে... সবসময় মনের ভেতর অস্থির লাগে। কোন কাজে আগ্রহ পাই না। অসম্ভব ক্লান্ত শরীর।’
‘তা হলে সবার আগে তোমার প্রয়োজন খাদ্য এবং বিশ্রাম।’ বলতে বলতে ভেতর বাড়ির দিকে রওনা হন বৃদ্ধ।
সাথে সাথে বাধা দেয় রাশেদ।
‘আপনি কষ্ট করবেন না, চাচা। আমি সত্যি কিছু খেতে পারি না।’
মৃদু হাসেন তিনি, ‘দেখা যাক, আমি পারি কিনা তোমার পছন্দসই কিছু খাওয়াতে।’
টেবিল ভরে সাজানো হয় নানান পদের খাদ্যসমগ্রী। অতিথি আপ্যায়নের চূড়ান্ত আয়োজন। সুমন তো খুশি হয়েই প্লেট টেনে নেয় কাছে, কিন্তু রাশেদের দেখেই অসহ্য লাগতে শুরু করে। কয়েক রকমের কাবাব, নানরুটি নানা রকম মিষ্টি-ফিরনি কিংবা শরবত—সব দেখেই বমি বমি ভাব হয়। ইচ্ছে হয় ছুটে পালিয়ে যেতে।
মৃদু হাসেন বৃদ্ধ। ভেতর বাড়ি থেকে পৃথক একটা প্লেট এনে রাখেন রাশেদের সামনে। মাথায় হাত রাখেন কোমল ভঙ্গিতে।
‘তুমি ক্ষুধার্ত, বাবা। খাও! নিঃসংকোচে খাও। না খেলে মানুষ বাঁচবে কী করে? তুমি খাও।’
সত্যিই তাই করে। খাবারটুকুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রাশেদ। খাবারটা ভালই। সেদিন রাতে আয়শার দেয়া মাংসের মতো অত ভাল না। তবে ভালই। অন্তত দীর্ঘদিন পর কিছু খেতে তো পারা যাচ্ছে।
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হয়। রাক্ষুসে খিদেটা মিটে যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রাশেদ। রাত হয়েছে অনেক, সুতরাং বিদায় নেয় সুমন। সত্যি কথা বলতে কী, বৃদ্ধ তাকে সরাসরিই বলেন চলে যেতে। রাশেদের সাথে একান্তে কথা বলতে চান তিনি। কিছু কথা কারোর সামনেই বলা যায় না।
বুদ্ধিমান সুমন অবশ্য এতে কিছু মনে করে না। জানিয়ে যায়, গলির সামনে পান-সিগারেটের দোকানে অপেক্ষা করবে সে।
‘আমাদের কী খাওয়ালেন আপনি, চাচা?’
আবার হাসেন বৃদ্ধ। ‘তোমার ভাল লেগেছে?’
‘হ্যাঁ। অনেকদিন পর কিছু খেতে পেরেছি। জিনিসটা কী ছিল?’
‘গরুর মাংস... কাঁচা গরুর মাংস! মসলায় মাখানো।’
আঁতকে ওঠে রাশেদ। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, আঁতকে উঠলেও ঘেন্না হয় না একটুও। বমিও করতে ইচ্ছা হয় না। বরং পেট পুরে খাওয়ার পর শরীরে ছড়িয়ে যাওয়া আরামদায়ক উষ্ণতাটা একরকম উপভোগই করে।
‘এটা কী করে সম্ভব? এতকিছু থাকতে কাঁচা মাংস কেন ভাল লাগবে?’
‘লাগতে পারে, বাবা। লাগতেই পারে। পৃথিবীতে আমাদের জ্ঞানের সীমার বাইরে কত কিছু আছে। সব কি আমরা জানি?’
‘কিন্তু ... What’s wrong with me?’
‘উত্তেজিত হয়ো না, বাবা। হয়তো তোমাকে একটুখানি ব্যাখ্যা করতে পারব আমি। কিন্তু বেশি না।’ একটু দম নেন বৃদ্ধ। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেন। ‘অনেক বছর আগে একজন মহিলা এসেছিলেন আমার কাছে। কমবয়সী গৃহবধূ, গর্ভবতী। সন্তান গর্ভে আসার পর থেকেই তার শুধু কাঁচা খাদ্য খেতে ইচ্ছা করত। অন্য কিছু নয়, শুধুমাত্র মাংস।’
‘কিন্তু কেন?’
‘আমি ঠিক জানি না। চেষ্টা করেছি, জানতে পারিনি। প্রতিটি মানুষের মাঝে কোথাও একটা অন্ধকার জগতের অস্তিত্ব থাকে। আমরা যতই চেষ্টা করি, একে অস্বীকার করা সম্ভব না। আমার মনে হয়, কোনও বিশেষ ঘটনা এই অন্ধকার অংশকে জাগিয়ে তুলতে পারে। সেই মহিলার সাথে সে রকম কিছু ঘটেছিল। তোমার সাথেও ঘটেছে। আমার সে রকমই ধারণা।’
‘সেই পচা-বাসি মাংস খাওয়ার ঘটনা...’
‘হ্যাঁ, হয়তো সেটাই। কিন্তু তা কোন সাধারণ মাংস হয়ে থাকলে তেমনটা হবার কথা নয়।’
‘তা হলে?’
‘অনেক প্রেত সাধকেরা কাঁচা মাংস খেয়ে থাকে। সেটাই তাদের প্রধান খাদ্য... আমার মনে হয় তোমার বাসায় এমন কেউ আছে, যে প্রেত সাধনা করে থাকে।’
‘কিন্তু আমার বাসায় তো...’
‘আমি জানি। তুমি আর তোমার স্ত্রী আছে শুধু।’
‘তা হলে...তা হলে কি, আয়শা?’
‘হতে পারে, অসম্ভব কিছু না। এটা একটা মানসিক অসুবিধা। ঠিকমতো চিকিৎসা করালে ভাল হয়ে যাবে।’
‘তোমার সমস্যাটার সমাধান তোমার নিজের হাতে। তুমি ইচ্ছা করো, নিজের অন্ধকার জগতের পথ রোধ করে দাঁড়াও...’
আরও অনেক অনেক কথাবার্তা হয়। কিছু বুঝতে পারে রাশেদ; কিছু পারে না। নেশাগ্রস্ত মানুষের মতো এলোমেলো পদক্ষেপে বেরিয়ে আসে, খুঁজে বের করে সুমনকে।
‘উনি কী করেন, সুমন? ওনার পেশা কী?’
হাসে সুমন। ‘কার কথা বলছিস?’
‘ওই যে...ওই বৃদ্ধ ভদ্রলোক!’
‘তার আগে বল, তোর সমস্যাটা মিটেছে? শরীর খারাপ ভাবটা কমেছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘মাথা ঘোরা কমেছে? আর ক্লান্ত লাগছে না তো?’
‘একদম না।’
‘বমি বমি ভাবটা গেছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘উনি কী বলেছেন তোকে?’
‘বলেছেন, পুরো ব্যাপারটা আমার হাতে। আমার ইচ্ছাশক্তির উপর নির্ভরশীল।’
‘খুব ভাল কথা। দেখ তো, এটা খেতে পারিস নাকি।’ বলে একটা ক্যান্ডিবার রাশেদের দিকে বাড়িয়ে দেয় সুমন। রাশেদের প্রিয় ক্যান্ডিবার।
খাওয়া যায় সহজেই। খেতে ভালও লাগে। রিকশা করে যেতে যেতে বেনসনও সাবাড় করা হয়। মনটা ভীষণ ফুরফুরে লাগে রাশেদের।
যাক্ বাবা, সমস্যা তো মিটেছে!
‘থ্যাংকস, দোস্ত!’ ভীষণ আন্তরিক কণ্ঠে বলে রাশেদ। ‘তোর জন্যে যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেলাম আমি। তুই যদি ভদ্রলোকের কাছে না নিয়ে...’
মিটিমিটি হাসে সুমন। ‘ওনার পেশা কী জানিস?’
‘কী?’
‘ঝাড়-ফুঁক। মানে ভূত-প্রেতে ধরা মানুষের ‘‘চিকিৎসা’’ করেন আর কী।’
ভীষণ বিস্মিত হয় রাশেদ। ‘How silly! তুই আমাকে ভূতের ওঝার কাছে নিয়ে গিয়েছিলি? একবিংশ শতাব্দীতে এসব কথা কেউ বিশ্বাস করে?’
‘করার প্রশ্নই ওঠে না। আমি শুধু তোকে একটা ঝাঁকি মারতে চেয়েছিলাম। মেডিকেল সায়েন্সের প্রতি ভরসা হারিয়ে ফেলেছিলি। তাই ভাবলাম উদ্ভট একটা জায়গায় রহস্যময় পরিবেশ আর অন্যরকম একটা মানুষ হয়তো নিজের প্রতি তোর বিশ্বাসটা ফিরিয়ে দিতে পারবে। এই বৃদ্ধের কথা বলার ভঙ্গিটা সাংঘাতিক। যাই বলে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে।’
সুমন লক্ষ করে না, কিন্তু খুব সাবধানে বুকে জমে থাকা দূষিত ভাবনগুলো বের করে দেয় রাশেদ। সত্যিই তো, একটা লোক বলল আর আয়শাকে নিয়ে আজেবাজে ভাবনা ভাবতে শুরু করে দিল সে? এর চাইতে আহাম্মকি আর হতে পারে না!
ভূতের ওঝা!!!
ভাবতে গিয়ে নিজেরই হাসি পায় রাশেদের। সুমনের নিশ্চয়ই নাটকটার পিছনে বেশ কিছু টাকা-পয়সা খরচ হয়েছে। এমনিতেও দিলে নেবে না। পায়ে ধরে সাধলেও না। সুতরাং ভাল দেখে একটা উপহার কিনে দিতে হবে...
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাসায় পৌঁছে যায় রাশেদ। রোকসানার জ্বর এসেছে। মাথার কাছে বসে কপালে পানি দিচ্ছে আয়শা। একটু পরপর চোখ মুছছে। সেবা করবে কী, নিজেই কাঁদতে কাঁদতে অস্থির বেচারী।
গভীর ভালবাসা নিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে রাশেদ। পৃথিবীতে এত মমতাময়ী বোধহয় অন্য কোন নারী নেই!
চলবে...........
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন