প্রেতে ও মানুষে। পর্ব-২
পরদিন আবার ঠিক রাত বারোটার সময় মালতীর আগমন হল, পড়া সেরে বাইরে যেতেই নরেন দরজার কাছে মালতীকে দেখতে পেল। তারপর দুজনে ঘরে এসে গল্প গুজব করতে লাগল।
এইরূপে দিন কাটছে, নরেনের লেখাপড়া চুলোয় গেছে। সে সারাক্ষণ মালতীর কথা ভাবে, উদগ্রীব হয়ে থাকে কখন রাত ১২ টা বাজবে। এমনিই তার আকর্ষণ, মালতীর সঙ্গ উন্মাদকর এবং রাত ১২ টা থেকে রাত ২ টো পর্যন্ত এই দু ঘণ্টা যেন সুখ স্বপ্নের মধ্য দিয়ে কেটে যায়। নরেনের প্রায়ই মনে হয়, মেয়েটি আসলে কে? কোথায় থাকে, কার মেয়ে, কেন রাত ঠিক বারোটায় এসে দুটোয় চলে যায়! সে কিচ্ছু বুঝতে পারে না।
তাকে জিজ্ঞাসা করলে মালতী কেবল হাসে আর বলে, ' আমার পরিচয় নিয়ে কি হবে? কেন আমায় কি পছন্দ কর না? তুমি প্রায়ই জিজ্ঞেস কর কেন আমি রাত ১২ টায় এসে ২ টোয় চলে যাই। তার কারণটা বলি শোন, কেবল এই রাত বারোটা থেকে দুটো পর্যন্ত যে ক্ষণ, শুধু সেই সময়টাতেই আমি তোমার কাছে আসতে পারি। আমার এমন ক্ষমতাও নেই যে রাত বারোটার আগে আসি বা রাত দুটোর পরেও থাকি।"
নরেন এসব শোনে আর মনে কেমন একটা সন্দেহের উদয় হয়। এক একবার এও মনে হয়, এ কি তবে মানুষ নয়? আরও একটা সে জিনিস সে লক্ষ্য করেছে মালতী চলে যাবার পর তার দেহ মনে একটা গভীর অবসাদ আসে।
সে মড়ার মতো ঘুমিয়ে পড়ে আর পরদিন উঠতে অনেক বেলা হয়ে যায়। সে আরও লক্ষ্য করল যে তার শরীর দিনে দিনে শুকিয়ে যাচ্ছে। ক্রমে ক্রমে সে বুঝতে পারল যে মালতীর সঙ্গ তার পক্ষে মঙ্গলজনক নয়। কিন্তু কি করা যায়? কি করে এর হাত থেকে উদ্ধার পাবে? এইভাবে আর কদিন চললে যে তার শরীর একেবারে ভেঙে পড়বে।
নরেন উপায় ঠাওরাতে লাগল কিভাবে মালতীর আসা বন্ধ করা যায়। সে ভাবলে, মালতী যখন বলেছে যে রাত ১২ টার আগে আসতে পারে না তখন তার আগেই কেন না সে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে? সে বন্ধ দরজা দেখে চলে যাবে।
সেদিন রাত্রে নরেন রাত এগারোটায় দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। সে ঘুমোবার চেষ্টা করল কিন্তু ঘুম এল না। যখন জমিদারবাড়িতে ঢং ঢং করে রাত ১২ টা বাজল তখন নরেনের ঘরের ভেতর কেমন একটা খসখস শব্দ হল। তাতে চোখ মেলে নরেন দেখল ঘরের ভেতর মালতী দাঁড়িয়ে আছে। নরেন এই ব্যাপারটায় হতভম্ব হয়ে গেলেও আবার মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ল আর তাকে সাদর সম্ভাষণ করল।
মালতী হাসিমুখে বললে, " আজ যে দরজা বন্ধ করে রেখেছিলে?"
নরেন বলল " শরীরটা আজ একটু ভাল নেই তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম। তুমি বন্ধ দরজার মধ্য দিয়ে ঢুকলে কি করে?"
মালতী হাসতে হাসতে বলল, " আমি একটা ম্যাজিক জানি। দরজা বন্ধ থাকলেও কি করে ঘরে ঢোকা যায় সেটা তোমায় একদিন আমি বুঝিয়ে দেব।
সে রাতে মালতী চলে গেলে নরেন এক লহমাও ঘুমোতে পারল না। এতদিন যেটা সে মনে মনে সন্দেহ করছিল এবার সেই ধারণা তার বদ্ধমূল হল। মালতী যে মানুষ নয়, কোন মৃত স্ত্রীলোক- এই ব্যাপারে নি:সংশয় হল সে। আতঙ্কে তার সারা দেহ শিথিল হয়ে এল এবং বুকের ভেতর কেমন করতে লাগল। তার মনে হল, আত্মা তো অশরীরী, সে স্থুল দেহ ধারণ করে কি করে! ক্রমে নরেনের মনে পড়ল, মালতী বারবার বলেছে, রাত বারোটা থেকে দুটো পর্যন্ত যে ক্ষণ শুধু সেই সময়টুকুতেই সে তার কাছে আসতে পারে। নরেনের মনে হল, হয়ত এই সময়টুকুর জন্যই মালতী স্থুল দেহ ধারণ করতে পারে।
নরেনের এ সন্মন্ধে কোনও জ্ঞান ছিল না তাই সে তখন সঠিকভাবে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে না পারলেও এটা বুঝল এভাবে আর কিছুদিন চললে পরীক্ষা পাশ করা দূরে থাক তার প্রাণসংশয় হবে।
এর দু চারদিনের ভেতরেই নরেন কঙ্কালসার হয়ে পড়ল। ভয় ও প্রেতসঙ্গ তার শরীর ও মনকে দগ্ধ করে দিল। দিন-রাত তার খাওয়া নেই, ঘুম নেই, কেবল রাত্রে ওই দু ঘন্টা সে ভুলে থাকে। এমনি মালতীর আকর্ষণ আর এমনিই নরেনের মোহ।
জমিদারবাড়ির সকলের নজরে পড়ল নরেন কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে। একদিন জমিদার গৃহিণী অনুযোগ করলেন যে, নরেন যেন রাত জেগে বেশী পড়াশুনা না করে। তার পুষ্টিকর খাবারেরও ব্যবস্থা করলেন কিন্তু কোনও ফল হল না। তখন গৃহিণী একদিন জমিদারবাবুকে নরেনের শারীরিক অবস্থার কথা জানালেন।
দেবেনবাবু তখন নরেনকে ডেকে পাঠালেন ও তাকে বহু প্রশ্ন করলেন। নরেন প্রথমটায় লুকোতে চেষ্টা করল, কিন্তু জমিদারবাবুর প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে শেষটা সে মেয়েটির কথা বলে ফেলল। একজন ভদ্রলোকের মেয়ে রোজ রাত্রে ঘরে আসে শুনে দেবেনবাবু চমকে উঠলেন ও নানাভাবে মেয়েটির পরিচয় জানতে চাইলেন। নরেন বললে, " আমি জিজ্ঞাসা করেছি, কোনও পরিচয় দেয় না"।
জমিদার বললেন, " তুমি তাকে ঘরে ডেকে আন কেন?"
নরেন বলে, " আমি ডাকি না, সে আপনি আসে"।
জমিদার বললেন, " তুমি দরজা বন্ধ করে থাক না কেন? তুমি তো বলছ যে রাত ১২ টার আগে মেয়েটি আসতে পারে না। তুমি তার আগেই দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড় না কেন?"
নরেন বলে, " আমি দরজা বন্ধ করে দেখেছি। দরজা বন্ধ থাকলেও সে আসে"।
জমিদার এবার অবিশ্বাসের হাসি হাসলেন। বললেন, " কি গ্যাঁজাখুরি কথা বলছ? দরজা বন্ধ থাকলে সে আসবে কি করে?"
নরেন বলে, "তা জানি না, বোধ হয় তার কোনও অমানুষিক ক্ষমতা আছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে খালি হাসে আর বলে, একদিন বুঝতে পারবে।"
নরেনের কথা শুনে দেবেনবাবু বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লেন। তিনি জানতেন নরেন সত্যবাদী ও সৎ, বিশেষ করে তাঁর সামনে সে কখনোই মিথ্যে বলবে না। তিনি নরেনকে বললেন, " তুমি আমায় এ ব্যাপারটা দেখাতে পার?"
নরেন বললে, " নিশ্চয় পারি, আপনি রাত বারটার কিছু আগে থাকতে আমার পাশের ঘরে লুকিয়ে থাকলেই সব দেখতে শুনতে পাবেন"।
দেবেনবাবু তখনি নরেনের ঘরে গেলেন ও দরজা-জানলা সব পরীক্ষা করে বুঝলেন যে, দরজা বন্ধ থাকলে বাইরে থেকে সে ঘরে আসা অসম্ভব! এই ঘরের পাশেই একটা ছোট ঘর ছিল আর দুই ঘরের মধ্যে একটা ছোট জানলা ছিল।
দেবেনবাবু পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রাত ১২ টার কিছু আগে সেই ছোট ঘরটায় গিয়ে বাতি নিভিয়ে লুকিয়ে রইলেন, আর নরেনের ঘরের ওপর খর দৃষ্টি রাখলেন। দেবেনবাবু এইভাবে চেয়ে আছেন আর নরেনের ঘরে আলো জ্বলছে। নরেন আজও দরজা বন্ধ করে শুয়েছে। ঠিক ১২ টার সময় তাঁর চোখে কেমন ধাঁধাঁ লাগল। মূহুর্তের জন্য চোখ বুজে ফেলে পরক্ষণেই চেয়ে দেখলেন যে একটি সুন্দরী মেয়ে নরেনের ঘরের ভেতর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কি থেকে কি হল তিনি কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। তারপর মালতী ও নরেন যখন কথাবার্তা বলতে লাগল তখন তিনি চুপিসাড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মালতী যে প্রেতিনী সে বিষয়ে তাঁর কোনও সন্দেহ রইল না।
পরদিনই তিনি নরেনের বাবাকে জরুরী পত্র লিখে ঘোড়সওয়ার দিয়ে পাঠালেন। সেই পত্রে তিনি লিখলেন, তুমি এখনি এসে তোমার ছেলেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাও, নইলে তার প্রাণ সংশয়। ওদিকে নরেনকেও ডেকে বললেন, " তোমার বাবকে আনতে লোক গেছে, তিনি ফিরলেই যেন তুমি ওনার সাথে চলে যেও"।
নরেনও রাজি হয়ে গেল।
সেইদিনই নরেনের বাবা রামবাবু এসে পড়লেন। সব দেখে শুনে তিনি ভয়ে দু:খে পাগলের মতো হয়ে গেলেন। দেবেনবাবু তাঁকে স্বান্তনা দিয়ে বললেন, " শুধু নিয়ে গেলে হবে না, ওকে একটা ভাল ওঝাও দেখাও। ওকে পেতনীটা যেভাবে পেয়েছে, তাতে ওকে ছাড়ান খুব শক্ত"।
রামবাবু সেদিনই নরুকে নিয়ে ঊষা গ্রামে ফিরে গেলেন।
নরেনের মা ও সব দেখেশুনে কেঁদে সারা। তিনিও বললেন, " পরীক্ষা মাথায় থাক, ছেলের প্রাণ বাঁচান আগে দরকার"।
নরেনও মা বাবার কাছে এসে হাঁফ ছাড়ল। ভাবল, যাক পেতনীটা হয়ত এখানে আর আসতে পারবে না"।
সে খেয়েদেয়ে রাতে নিজের ঘরে শুতে গেল।
কিন্তু ঘুম আর তার আসছে না। ক্রমেই রাত হচ্ছে আর নরেনের কেমন আশঙ্কা হচ্ছে, মালতী আবার এখানেও আসবে না তো!"
এইভাবে রাত বারোটা বাজল,
চলবে............
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন