প্রেতে ও মানুষে। পর্ব-৩
রাত ১২ টা বাজতেই নরেন দেখল, ঘরের ভেতর মালতী দাঁড়িয়ে আছে। নরেন অবাক হল, ভয় পেল কিন্তু সেই আগের মতো মোহাবিষ্ট হয়ে সাদর সম্ভাষণ করল।
মালতী বলল, " তুমি যে এখানে চলে এলে? তুমি কি ভাবছ?"
নরেন বললে, " ভাবছি তুমি এখানে কি করে এলে? আমার শরীর খারাপ বলে বাবা আমায় এখানে নিয়ে এসেছেন"।
মালতী বললে, " তুমি সত্যি বলছ? তোমায় আমার কাছ থেকে ছাড়াবার চেষ্টা হচ্ছে না তো? সে কিন্তু কেউ পারবে না, তা কেউ যত চেষ্টাই করুক না কেন। তুমি কি এতদিনেও বুঝতে পারনি, আমি কে? তোমায় আমার খুব ভালো লাগে। তুমি যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাব। তুমি যতদিন বেঁচে থাকবে আমি ততদিন এইভাবে আসব। তোমার মৃত্যুর পর চিরকাল আমরা একসঙ্গে থাকব"।
মালতীর এই কথায় নরেনের বুক কেঁপে উঠল। যদিও সে জানত মালতী মানুষ নয় কিন্তু এমন খোলাখুলি ভাবে কথা কখনো হয় নি। যখন মালতী বলল, 'কেউ তোমায় আমার কাছ থেকে ছাড়াতে পারবে না', তখন ভয়ে নরেনের সর্বাঙ্গ শিথিল হয়ে এল। সে যদিও অন্যদিনের মতো হাসিখুশীর ভান করল কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে তার মুখ শুকিয়ে উঠতে লাগল।
দুটো বাজলে মালতী চলে গেলে নরেন পাগলের মতো ছুটে গিয়ে তার মা-বাবার শোবার ঘরের দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল। তাঁরা তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বেরিয়ে এসে সব শুনে পাগলের মতো হাহাকার করে কাঁদতে লাগলেন। সে রাতে কেউ আর ঘুমোতে পারল না।
পরদিন রামবাবু প্রতিবেশীদের ডেকে এনে সব কথা বললেন। তাঁরাও বললেন, " যত শীঘ্র সম্ভব একজন ভালো ওঝাকে ডাকা হোক। আর যতদিন ওঝা না আসে ততদিন নরেন তার মা বাবার মাঝখানে শোবে। "একজন এ সংবাদও দিল যে সাত ক্রোশ দূরে একজন সত্যিকার ভাল ওঝা থাকে। তার ভূতপ্রেত সন্মন্ধে গভীর জ্ঞান, আর সে অনেক দরকারী শিকড়-বাকড়ের সন্ধান রাখে। সেইদিনই ওঝাকে আনতে লোক পাঠান হল, আর তাকে বলে দেওয়া হল যাতে পরদিনই সে ওঝাকে নিয়ে আসে। ওঝা যা চাইবে তাকে তাই দেওয়া হবে.....এ কথাও তাকে বলে দেওয়া হল।
সেদিন রাত্রে নরেন বাবা মার মাঝখানে শুল। তিনজনই পাশাপাশি জেগে শুয়ে আছেন, আতঙ্কে দুশ্চিন্তায় কেউ ঘুমোতে পারছেন না।
এইভাবে রাত বারোটা বাজল।
নরেন চোখ বুজে শুয়েছিল। হঠাৎ সে অনুভব করল কে যেন তাকে ঠেলছে। নরেন চমকে চোখ মেলে চেয়ে দেখল যে মালতী মাথার কাছে বসে আছে। নরেন চুপি চুপি বলল, " তুমি কি করছ, বাবা মা জানতে পারবেন যে"।
মালতী স্বাভাবিক সুরে বলল, " তোমার ভয় নেই, ওরা কিচ্ছু জানতে পারবেন না"।
নরেন উঠে দেখল যে তার বাবা মা মড়ার মতো ঘুমোচ্ছে। তারা তখন পাশের ঘরে এল। বলা বাহুল্য, মালতীই রামবাবু ও তাঁর স্ত্রী কে অজ্ঞান করে রেখেছিল।
পরদিন সব শুনে তাঁরা পাগলের মতো হয়ে গেলেন। নরেনও বুঝল তার আর নিস্তার নেই। আতঙ্কে দুশ্চিন্তায় তার শরীরের আর কিছু নেই। দেহ কঙ্কালসার, সব সময় বুক ধড়ফড় করে, মাথা ঘোরে। বহুকষ্টে হাঁটে, এমনকি বসতেও কষ্ট হয়। সে-ও ভাবে, এই অবস্থার চেয়ে মরে যাওয়াও ভাল। গ্রামের লোকরাও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। সকলের শেষ আশা সেই ওঝা।
সেদিনই বিকেলে ওঝার আগমন হল। সে ধীরভাবে আগাগোড়া সব শুনল, নরেনের শারীরিক অবস্থাও দেখল। তারপর বলল, সে একবার নির্জনে বসে পুরো ব্যাপারটা ভাববে। সে এ-ও বলল, মেয়েটা যেভাবে নরেনকে গ্রাস করে বসে আছে, তাতে তাকে ছাড়ান খুব শক্ত। এই বলে ওঝা একটা নির্জন গাছতলায় বসল। ঘন্টা দুই বাদে ওঝা ফিরে এসে বলল যে সে একটা উপায় বের করেছে, যদিও সেটা খুব বিপজ্জনক।
সে বলতে লাগল,
" আপনারা তো দেখছেন নরেনের অবস্থা। এইভাবে চললে একমাসের মধ্যে ওর মৃত্যু নিশ্চিত। শুধু একটা উপায় আছে যাতে একে বাঁচান যায়, কিন্তু সেই উপায়ের আর একটা দিক আছে সেটাও ভেবে দেখুন। আমার মতলব যদি সফল হয় তাহলে চিরকালের মতো নরেন প্রেতিনীর হাত থেকে রেহাই পাবে কিন্তু অকৃতকার্য হই তো আজই ওর প্রাণ যাবে। এখন আপনারা ভেবে দেখুন আপনারা ওর একমাসের মধ্যে নিশ্চিত মৃত্যু চান না তাকে চিরতরে বিপদমুক্ত করতে চান যদিও আজই এতে ওর প্রাণ যেতে পারে। ভেবে জবাব দিন"।
রামবাবুর স্ত্রী দরজার আড়াল থেকে সব শুনে কেঁদে উঠে বললেন, " বাপ রে, যাতে আজই আমার ছেলের প্রাণ যেতে পারে তাতে আমি কখনোই মত দেব না"।
রামবাবুও দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেছেন। সবাই তাকে বোঝাতে লাগল, এভাবে চললে একমাসের মধ্যে ওর মৃত্যু তো নিশ্চিত। আমাদের ওঝার কথাই মেনে চল উচিত। হয় আজই ও প্রেতিনীর হাত থেকে মুক্ত হবে নয়তো প্রাণ যাবে।
শেষটায় সর্বসম্মতিক্রমে স্থির হল ওঝার কথাই শোনা হবে।
ওঝা বললে, " আজ সন্ধে হয়ে গেছে। আজ আর কিছু হবে না। আর একটা রাত্রি নরেন এইভাবেই থাকুক, কাল এব্যাপারে হেস্তনেস্ত হবে। তবে এখানে নয়, যেখানে নরেনের সাথে তার প্রথম দেখা হয়েছিল সেখানে যেতে হবে"।
সেরাতে মালতী নরেনকে বলল, " তোমায় আগেও বলছি, এখনও বলছি, তোমায় আমার কাছ থেকে কেউ কাড়তে পারবে না। তুমি আগে যেখানে ছিলে সেখানেই যাও। আমার এখানে আসতে কিছু কষ্ট হয়"।
নরেন বলে, " তাই হবে। আমি কালই কল্যাণপুর ফিরে যাব"।
পরদিন কল্যানপুরের জমিদারবাড়িতে রামবাবু, নরেন ও ওঝা উপস্থিত হল। ওঝা জমিদার দেবেনবাবুকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলল, " আপনাকে কিছু সাহায্য করতে হবে"।
দেবেনবাবু সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন।
ওঝা বললেন, " বেশী কিছু করতে হবে না। আপনি শুধু নরেনের ঘরটা খুব ভাল করে ফুল আর মালায় সাজিয়ে দিন। তক্তাপোষ সরিয়ে একটা খাট পেতে দিন"।
দেবেনবাবু সেই ব্যবস্থাই করে দিলেন।
রাত দশটায় ওঝা নরেনকে নিয়ে সেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। সেখানে ওঝা তার সমস্ত প্ল্যানটা তাকে খুলে বলে আর বুঝিয়ে বলল, তাকে কি করতে হবে আর কি বলতে হবে। শেষকালে ওঝা বলল, " তোমার জীবন এখন তোমার হাতে, ভূতনাথ মহাদেবের কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন তোমার বুকে বল দেন"।
রাত্রি বারোটার কিছু আগে ওঝা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ঠিক রাত ১২ টায় মালতীর আগমন হল, নরেন খুবই আগ্রহের সাথে তাকে ফুল মালায় সজ্জিত সাজান খাটে বসতে বলল।
মালতী আশ্চর্য হয়ে বলল, " আজ একি ব্যাপার? এমন খাট, এত ফুলের মালা, এ কার জন্য?"
নরেন বললে, " কেন, তোমার জন্য আর তার পুরস্কারও তো পেলাম।
মালতী বলল, " কি পেলে?"
নরেন বললে, " কেন কোনদিন যা কর নি আজ তাই করেছ। এর আগে তো কোনওদিন দুবার আস নি?"
মালতী বলে, " দুবার মানে কি? আমি আবার কখন এলাম?"
নরেন আশ্চর্য হয়ে বলল, " এর মধ্যে ভুলে গেলে? তুমি রাত সাড়ে দশটায় এলে আর বললে যে আজ তুমি ফুল মালায় সাজান খাট দেখে আগেই এসেছ, আমার সঙ্গে ফুল নিয়ে কত কাড়াকাড়ি করলে, এই দেখ বিছানায় ছেঁড়া ফুল, ছেঁড়া মালা পড়ে আছে।
পনের মিনিট হল তুমি গিয়েছ, এর মধ্যে ভুলে গেছ না রসিকতা করছ?"
নরেনের কথা শুনতে শুনতে মালতীর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। মুখ হল অসম্ভব গম্ভীর, চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরোতে লাগল।
চলবে.........
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন