প্রেতে ও মানুষে। পর্ব-১
সে আজ অনেক কাল আগের কথা।
তখন বাংলার পল্লী অঞ্চল সমৃদ্ধিশালী ছিল এবং শহরাঞ্চলের এত উন্নতি হয় নি। গ্রামের ক্ষেত, পুষ্করিণী মানুষের অন্নবস্ত্রের সংস্থান করত। বাঙালীকে পাগল হয়ে চাকরীর জন্য শহরে ছুটে যেতে হত না, পরিবারগুলো একান্নবর্তী ছিল, পরিবারের পুরুষরা রুজি রোজগারের টানে কখনো সখনো বাইরে কাজ করলেও পরিবারের সদস্যেরা গ্রামেই থাকতেন। গ্রামের আশ-পাশ নির্জন থাকাতে লোকের মন ডাকাত ও ভূত প্রেতের ভয়ে আচ্ছন্ন থাকত।
সেই সময় আমাদের যশোর জেলার অন্তর্গত কল্যাণপুর নামক এক বর্ধিষ্ণু গ্রামে জমিদার দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ তাঁর পরিবারবর্গ সমেত বিশাল এক চক মিলান বাড়িতে বসবাস করতেন। বাইরের মহলে ছিল জমিদারের বৈঠকখানা, নায়েব গোমস্তাদের থাকবার ঘর আর অতিথিদের থাকবার ঘর। তাছাড়া অন্যদিকে দাস দাসীদের ঘরও ছিল। উপরের দোতলায় জমিদার দেবেন্দ্রনাথ তাঁর পরিবারবর্গ সমেত বাস করতেন।
কল্যানপুর থেকে দশ মাইল উত্তরে ঊষা গ্রামে তাঁর জমিদারী ছিল। সেখানে তাঁর নায়েব তসিলদার ছিলেন রামচন্দ্র পাল। তাঁর একটিমাত্র পুত্র নরেন বা নরু সেই বছর এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেবে। টেস্ট পরীক্ষা উত্তীর্ণ হলে নরেন তার বাবাকে বলল-
" বাবা, আমাদের বাড়িতে মাত্র দুটি ঘর। আমার পড়াশোনার খুব অসুবিধে হয়। ইউনিভার্সিটি পরীক্ষার আগে যদি আমি অন্য কোনও জায়গায় থেকে পড়াশোনা করতে পারি তাহলে আমি পাশ করা সন্মন্ধে নিশ্চিত হতে পারি"।
রামচন্দ্র পাল ছেলের অনুরোধ ফেলতে পারলেন না। তিনি তার সমস্যাটা বুঝলেন। কিন্তু সেই গ্রামে এমন কোনও বড় বাড়ি ছিল না যেখানে নরেন গিয়ে থাকতে পারে। তাঁর হঠাৎ জমিদার দেবেন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ল। তিনি ভাবলেন জমিদারবাবু নিশ্চয়ই তাঁর ছেলের থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন। তবে তিনি নরেনকে সাবধান করতে গিয়ে বললেন -
"দেখ নরু, জমিদারবাড়িতে তাঁর পরিবারবর্গের মেয়েরা আছেন, তাঁরা হয়ত তোমার সঙ্গে কথা বলবেন, তুমি খুব সাবধানে তাঁদের সাথে কথা বলবে। তোমার আঠার বছর বয়স হয়েছে, তোমায় বেশী কিছু বলাই বাহুল্য। দেখ, কোন নিন্দে যেন আমার কানে না আসে"।
নরেন বাবাকে আশ্বস্ত করে বলল " তুমি নিশ্চিন্ত থেকো বাবা। মনিববাড়ির মেয়েদের সাথে কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, আমি জানি"।
জমিদার দেবেন্দ্রনাথ তাঁর অতিথি নিবাসের একটা ঘর নরেনের জন্য খুলে দিলেন। এখানেই নরেন আগামী দু মাস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারবে।
নরেন যে ঘরটা পেল তার সামনেই রক, তারপরই উঠোন আর উঠোনের অপর দিকে অন্দরমহলে যাবার রক, যেখান থেকে অন্দরের উঠোনে যাবার শুঁড়িপথটি আরম্ভ হয়েছে। নরেন অন্দরে গিয়েই খাওয়া দাওয়া করত আর নিজের ভাল ব্যবহারের জন্য খুব শিগগীরইই জমিদার গিন্নী ও তাঁর কন্যাদের স্নেহ ভালবাসা আকর্ষণ করে নিল।
নরেন প্রত্যহ রাতে ঘুমোবার আগে আরও দুই ঘন্টা পড়াশোনা করে নিয়ে রাত ১২ টা বাজলে বাইরের রকে এসে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ত।
এইভাবে দিন যায়। এক রাতে নরেন রাত ১২ টা বাজতে বাইরের রকে হাত মুখ ধুতে এসেছে তখন দেখে অন্দরমহলে যাবার রকের দিকে একটা ঊনিশ-কুড়ির সুশ্রী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারই দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটি। নরেন ভাবল, জমিদারবাড়িরই কোন মেয়ে, তাই সে তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
পরদিন রাতে নরেন পড়ছে আর ভাবছে, কে ঐ মেয়েটি? অত রাতে রকে দাঁড়িয়ে কি করছিল? জমিদারবাড়িতে বা অন্য কোথাও দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না।
সেদিনও রাতে নরেন রাত ১২ টায় বাইরে এসে মেয়েটিকে একই জায়গায় দেখতে পেল। নরেন লজ্জা পেল কিন্তু অদম্য কৌতূহলবশত মেয়েটির দিকে চেয়ে রইল। মেয়েটিও ওর দিকে চেয়ে রইল। ক্রমে সে উঠোন পার হয়ে নেমে ধীরে ধীরে নরেনের দিকে এগোতে লাগল। নরেন আর অপেক্ষা করল না। তার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। সে তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে দরজা দিল।
নরেন সেরাতে ভাল ঘুম হল না। পরদিন সারাটা দিন উচাটন হয়ে রইল। কে ওই মেয়েটি? এত রাতে আমার ঘরের দিকে আসছিলই বা কেন? ও কি ভাল মেয়ে নয়? অথচ মুখ দেখে তো কিছু বোঝা যায় না। মুখে কেমন সরল ভাব, যেন কিছু বলবে। দেখি আজও যদি আসে তো পরিচয় নেবার চেষ্টা করব।
নরেন সেদিন একটুও পড়ায় মন বসাতে পারল না।
রাত ১২ টা বাজে। নরেন ঘরের বাইরে এসে দেখল মেয়েটি আজ রক থেকে নেমে উঠোনের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। নরেনকে দেখেই মেয়েটি তার কাছে অগ্রসর হয়ে এসে মিষ্টি স্বরে বলল " আজ কদিন হল তোমায় দেখছি। তোমায় আমার খুব ভাল লেগেছে। তাই একটু আলাপ করতে এলাম"।
মেয়েটির চোখে কি ছিল কে জানে! নরেন তাকে ফেরাতে পারল না। সে কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো বা মোহগ্রস্তের মতো হয়ে পড়ল। মন আর দেহ যেন আর স্ববশে রইল না। সে মেয়েটির সঙ্গে নিজের ঘরে প্রবেশ করল। তারপর বলল " তুমি কে?"
মেয়েটি বলল " আমি মালতী। তুমি আমায় চেন না। তোমায় আমার ভালো লেগেছে, তাই বন্ধুত্ব করতে এলাম। রাগ করোনি তো?"
নরেন বললে, " আচ্ছা তুমি এত রাতে আস কেন?"
মেয়েটি কেমন রহস্যের মতো হেসে বলল, "ঠিক রাত বারোটার সময় আমার আসার সময় হয়। অন্য সময় আমি চেষ্টা করলেও আসতে পারি না। এসব একদিন তুমি বুঝতে পারবে। আমি রোজ রাত ১২ টায় আসব আর ২ টোয় চলে যাব। তোমার কোনও ভয় নেই। আমি তোমার কোনও অনিষ্ট করব না। আমার পরিচয় জানতে চেও না। আমি তোমার বন্ধু এই-ই কি যথেষ্ট পরিচয় নয়?"
নরেন তখন স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল না। তা না হলে সে নিশ্চয় মেয়েটির পরিচয় নেবার জন্য পীড়াপীড়ি করত। কিন্তু সে তা করল না।
সে মেয়েটির সাথে গল্প করতে লাগল। তার একবারও মোহগ্রস্ত মনে, মনে হল না যে, এটা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। এক অপরিচিতা মেয়ে ঠিক রাত ১২ টায় আসে, এক মিনিটও আগে কি পরে আসতে পারে না.. এর মানে কি? তার আত্মীয় স্বজনই বা কোথায়? এসব কথা নরেনের মনে একবারও উদয় হল না। সে শুধু তার সাথে কথাবার্তার আনন্দে ডুবে রইল।
রাত ২ টো বাজতেই মেয়েটি উঠে বলল, " আজ যাই, কাল ঠিক বারোটায় আসব। " বলে মেয়েটি ঘরের বাইরে চলে গেল।
নরেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাইরে বের হয়ে আর মেয়েটিকে দেখতে পেল না। সারা উঠোন খাঁ খাঁ, কোথাও জনমনিষ্যির চিহ্নও নেই।
চলবে....................
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন