লজ্জা
ধরুন আপনি বই মেলায় ঢুকছেন। পর পর তিন জনকে দেখলেন হাতে আপনার লেখা বই নিয়ে মেলার মধ্যে হন হন করে হেঁটে চলেছে। তখন নিশ্চয়ই আপনি অবাক হয়ে যাবেন। নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখবেন ভুল দেখছেন না তো। তখন যদি কোকিল ডেকে ওঠে , চারিদিকে হেঁটে চলা মেয়েদের অপ্সরা মনে হয় আর আপনি যদি মনে মনে ভাবতে শুরু করেন যে আপনি কেবল স্বর্গোদ্যান হেঁটে বেড়াচ্ছেন তবে তাতে কোনো ভুলচুক হবেনা। ঠিক এমনটাই ঘটেছিলো আমার সাথে। সেই অভিজ্ঞতা কেমন সুখকর ছিল সেটাই আপনাদের জানাই।
প্রথমজন বেশ বয়স্ক ধুতি পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক। কেমন অবলীলায় আমার লেখা বইটা বাঁ হাতে দুলিয়ে দুলিয়ে হেঁটে চলেছেন। কি জানি কেন আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো আর্কিমিডিসের সেই বিখ্যাত উক্তি "ইউরেকা " . কাছে গিয়ে নমস্কার করে নিজের পরিচয় দিলাম। ভেবেছিলাম ভদ্রলোক বুঝি বইটা বাড়িয়ে দেবেন প্রথম পাতায় আমার নামের সই নেবার জন্য। তা না করে ভদ্রলোক কেমন সঙ্কোচের বিহ্বলতার মতন মুখ করে জিজ্ঞাসা করলেন ," কি নাম বললেন আপনার "? আমি সবিনয়ে নিজের নামটা বললাম। ভদ্রলোক বইটা উল্টে আমার নামটা বইতে ছাপা নামের সঙ্গে মিলিয়ে নিলেন। আমি তখন খুব আগ্রহ ভরে জিজ্ঞাসা করলাম ," আপনি নিশ্চয়ই খুব বই পড়েন" ? ভদ্রলোক কেমন নির্বিকার ভাবে উত্তর ," আমি বাপু ঐসব বই টই পড়িনা"। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস ," যদি বই না পড়েন , তবে আর পয়সা খরচ করে আমার বইটা কিনলেন কেন "? ভদ্রলোক এবার একগাল হেসে জানালেন ," আমি পেশায় কবিরাজ। সেই কবিরাজির ওষুধ পুড়িয়া করতে কাগজ লাগে। তাই আমি আপনার বইটা কিনলাম"। কথাটা শুনে আমার পা দুটো কেঁপে উঠলো। তাও আমি জিজ্ঞেস করলাম ," ওষুধের পুড়িয়া করার জন্য আমার বই কেন কিনলেন "? ভদ্রলোক বেশ একটু নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন ," কি সুন্দর ঝকঝকে কাগজে বই ছেপেছেন। এই রকম ঝকঝকে কাগজে ওষুধের পুড়িয়া বাঁধতে আমার খুব ভালো লাগে" । ভদ্রলোক এই বলে হন হন করে হাঁটা মারলেন। আমার কেমন যেন মনে হলো আমার পায়ের তোলার মাটি বুঝি কাঁপছে।
এরপর দেখি একজন গিন্নিবান্নি টাইপের পৃথুলা মহিলা আমার বই নিয়ে হেঁটে আসছেন। সেই দৃশ্য দেখে আমার সব মনের দুঃখ দুর হয়ে গেলো। কাছে গিয়ে নিজের দু কান ছোঁয়ানো হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ," আমার বইটা কিনেছেন দেখে খুব খুশি হলাম। বইটা পড়া হয়ে গেলে দয়া করে একটু ফোন জানাবেন কেমন লাগলো" ? এবার চমক খেলাম মাসিমার উত্তরে ," এ বইতো পড়ার জন্য কিনিনি। এই বইটা আমার রান্না ঘরে খুব কাজ দেবে"। আমি একটা হেঁচকি তুলে বলি ," আপনি নিশ্চয়ই ভুল করেছেন। এটা কোনো রান্নার বই নয়"। মাসিমা আবার আমাকে চমক দিলেন ," আমি তো জানি এটা রান্নার বই নয়"। শুনে আমি ভাবছি মহিলা নিশ্চয়ই খুব হেয়াঁলি। তবু সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম ," তবে আমার লেখা বইটা আপনার কোন কাজে লাগবে"। এবার মাসিমা বইটা দেখিয়ে বললেন ," আমার রান্না ঘরে প্রচুর আরশোলা। আমি ওদেরকে মারার জন্য বেগন স্প্রে ব্যবহার করতে রাজি নই । পাছে খাবারে পড়লে , ঘরে বিষক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। তবে আপনার লেখা এই শক্ত পোক্ত বাঁধাই করা বই দিয়ে খুব সহজে আরশোলা পিটিয়ে মারতে পারবো। তাই কিনে ফেললাম"। আমার কেমন যেন মনে হলো চারিদিকের বইমেলা আমার চোখের সামনে আবছা হয়ে আসছে। ভাগ্যিস পাশেই বিশ্ব বঙ্গের প্রতীক ওই গোল গ্লোবটা ছিল। কোনো মোতে সেটা আঁকড়ে ধরে আমি রেহাই পেয়ে গেলাম।
এরপর দেখি এক অল্প বয়সের স্বামী স্ত্রী , সঙ্গে একটা বছর খানেকের বাচ্চা মেয়েটার কোলে। এক হাতে বাচ্চা আর অন্য হাতে ধরা আমার বই। সেই দৃশ্য দেখে ভাবলাম বাংলা বইর পাঠক এমনই হওয়া উচিত। ঘর সংসারের সব কাজ সামলেও বই পড়ার জন্য ঠিক সময় বার করে নেয়। ওদেরকে থামিয়ে আমি আমার পরিচয় দিলাম। জিজ্ঞেস করি ," আমার বইটা পড়া হয়ে গেলে একটু জানাবেন কেমন লাগলো"। ছেলেটা উত্তর দিলো ," আমি ঠিক পড়ার জন্য বই কিনিনি"। আমি আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করি ," তবে কিনলেন কেন" ? ছেলেটা বেশ গম্ভীর ভাবে উত্তর দিলো ," এর সহজ উত্তর হচ্ছে ইকোনোমিক থিওরি। আপনার ১০০ পাতার বইর দাম ডিসকাউন্ট ব্যাড দিয়ে ১০০ টাকা। তার মানে প্রতি পাতার দাম পড়লো ১ টাকা। বই মেলাতে আর যে সব বই বেরিয়েছে সব ওই ৪০ পাতা থেকে ৮০-৯০ পাতার মতন। কিন্তু ওই সব বইর দাম ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকার মতন। কাজেই প্রতি পাতার দামের হিসাবে আপনার বই সবচেয়ে সস্তা"। আমার তখন ভিরমি খাওয়ার মতন অবস্থা। বাপের কেন ঠাকুর্দার জন্মেও কখন শুনিনি যে কেউ প্রতি পাতার দামের হিসাব করে বই কেনে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলি ," আপনার কথায় মানলাম যে আমার বই প্রতি পাতার দামের হিসাবে সস্তা। কিন্তু জানতে চাই আপনি যদি নাই পড়তে চান তবে খরচ করে আমার বইটা কিনলেন কেন "? এবার মেয়েটা কোলের বাচ্চাটাকে ছুনুমুনু করে আদর করে বললে ," জানেন তো আমার বাচ্চার কি যে রোগ হয়েছে , কত ডাক্তার দেখলাম তাও রোগ সরেনা"। দুঃখিনী মাতার কথায় আমার মন কেমন গলে গেলো। বইর কথা ভুলে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ," বাচ্চাটার কি হয়েছে"। মেয়েটা এবার কাঁধে ফেলে রাখা বাচ্চাটার পীঠ থাবড়াতে থাবড়াতে বললে ," আমার বাচ্চাটা না বেবি কমোডে পটি করতে চায়না। কত চেষ্টা করলাম কিছুতেই করবেনা। শেষ মেশ ট্রাই করে দেখলাম যে যে কোনো নতুন বইর পাতা ফেলে বসিয়ে দিলে কি সুন্দর পটি করে। তাই তো ও আপনার বইটা কিনে দিলো। কি সুন্দর ছাপা আর কি ঝকঝকে কাগজ। এতে আমার বাচ্চার পটি দু মিনিটে শেষ হয়ে যাবে"।
পটির কথা শুনে কেন কি জানি নিজের নাক কুঁচকে গেলো আর আমি হনহনিয়ে মেলার ভিতরে সিঁধিয়ে গিয়ে নিজেকে লুকালাম। তখন খালি মনে পড়লো চার্লস ডিকেন্সের সেই প্রখ্যাত উক্তি “We need never be ashamed of our tears.” ভাবলাম ওই ডিকেন্স সাহেবেরও বুঝি এমন কোনো লজ্জাস্কর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সে কথা ভাবতেই মনে একটা বল পেলাম , শক্তিমানের মতন আকাশে উড়তে ইচ্ছে হলো। আমি আবার হেঁটে চললাম বুক স্টলের দিকে যেখানে আমার বই হাঁ করে পথ চেয়ে বসে আছে কখন কোন ক্রেতা এসে ওকে উদ্ধার করে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন