ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। গান্ধিজি পালন করছেন অহিংস অহসযোগ আন্দোলন। ভগৎ সিং রা তখন ফাঁসির দড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন। গান্ধীবাদি অহিংস নীতিতে তাদের বিশ্বাস ছিল না অন্যান্য বিপ্লবীদের মতোই। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্র তখন কলকাতা। ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হামলা যখন শুরু করেন বিপ্লবিরা তখন গান্ধী এক বছরের জন্য সেই হামলা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন এবং অহিংস আন্দোলন চালিয়ে যেতে বলেন। গান্ধীর এই এক বছর শেষ হলেও কার্যত অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। এই কথিত এক বছর সময়ের পরও কংগ্রেস অহিংসার নীতিতেই অটল থাকে। আন্দোলনের কেন্দ্র কলকাতায় যা হয়নি,বিশাল ভারত বর্ষের অন্য কোথাও যা হয়নি- এবার তেমন একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত হল বাংলার চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের এক বিদ্যালয়ের অংকের শিক্ষক সূর্য সেনের হাত ধরেই স্বাধীনতার সূর্য ওঠার পথে এক ধাপ অগ্রসর হলো ভারতবর্ষ। সূর্য সেনের পরিকল্পনা যেকোন দৃষ্টিতেই ছিল ভয়াবহ, বিপজ্জনক এবং আত্মঘাতী। তিনি ও তার সাথীদের পরিকল্পনা ছিল চট্টগ্রামে পুলিশ লাইন, ক্যান্টনমেন্ট, টেলিগ্রাফ অফিস, ইউরোপীয়ান ক্লাব একযোগে আক্রমন করে দখল নেয়া এবং অস্ত্রগার লুঠ করা। চট্টগ্রামকে তিনি ব্রিটিশ মুক্ত করতে চেয়েছিলেন,স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন – যেন তাদের এ পদক্ষেপ সমগ্র ভারত বর্ষে আগুন ছড়িয়ে দেয়। সূর্য সেনের এই মারাত্মক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দরকার ছিল বেশ তরুণ যোদ্ধা। সূর্য সেন তাই এমন কিছু কিশোর বয়সী ছেলেদের কাজে লাগান যাদের মধ্যে ছিল কিছু করার তীব্র ইচ্ছা, ইংরেজদের থেকে দেশ স্বাধীন করার আকাংক্ষা। এই তরুণ দলের মধ্যেই ছিলেন বিনোদ বিহারি চৌধুরী। এই তরুণ দলকে প্রশিক্ষণ দিয়ে মাস্টারদা সূর্য সেন ও তার অন্যান্য বিপ্লবী সহযোদ্ধারা আসন্ন আক্রমনের জন্য প্রস্তুত করে তোলেন। এই দলের সাথেই ছিলেন প্রীতিলতা এবং কল্পনা দত্ত। খুব সূক্ষ্মভাবে পরিকল্পনা করে অবশেষে ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল আক্রমণের দিন ধার্য হয়। কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে বিপ্লবীরা টেলিগ্রাফ অফিস,পুলিশ লাইন, ক্যান্টনমেন্ট আর ইউরোপীয়ান ক্লাবে ছড়িয়ে যান। যথাসময়ে আক্রমণ করা হয়। সূক্ষ্ম পরিকল্পনা থাকলেও দুটি মারাত্মক ভুল করে বসেন তারা। ইউরোপীয়ান ক্লাব ছিল ইংরেজ দের ক্লাব। রাতে এখানে তারা আড্ডা পার্টি করত প্রতিদিন। বিপ্লবীদের পরিকল্পনা ছিল এখানে আক্রমণ করে সব ইংরেজদের জিম্মি করে ফেলা। অফিসারদেরকে এখানে জিম্মি করে ফেলতে পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে, এটাই ছিল তাদের চিন্তা। কিন্তু আক্রমণের দিন অর্থাৎ ১৮ এপ্রিল ছিল ‘গুড ফ্রাইডে’ অর্থাৎ ঐদিন কোন ইংরেজ ক্লাবে আসেই নি, বিপ্লবীদের একটি দল ইউরোপীয়ান ক্লাব দখল করে দেখেন সেখানে কোন ইংরেজ নেই। ক্যান্টনমেন্ট দখল নিয়ে সেনাদেরকে ব্যারাকেই আটকে ফেলেন বিপ্লবীরা। অস্ত্রাগার লুট করেন এবং দেখেন যে অস্ত্রাগারে কেবল অস্ত্রই পড়ে আছে- নেই কোন কার্তুজগুলি। আর্মি সিক্রেট হিসেবে অস্ত্র আর কার্তুজ এক সাথে রাখা হতো না- যা জানা ছিল না বিপ্লবীদের। অর্থাৎ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র হস্তগত হলেও কার্যত সেগুলো ছিল অচল। বিপ্লবীদের ভরসা ছিল এই অস্ত্রগুলোই। কারণ তাদের কাছে যে অস্ত্র আছে তা ছিল নিতান্ত অপ্রতুল। এর মধ্যে ব্যারাক ভেঙে সৈন্যরা বেড়িয়ে পড়ে-গুলি বিনিময়ের পর বাধ্য হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয় বিপ্লবীরা। পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তারপরও সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ায় চট্টগ্রাম কার্যত স্বাধীন ছিল ৪ দিন। বিপ্লবীরা আশ্রয় নিয়েছিল জালালাবাদ পাহাড়ে কিন্তু তাদের খাদ্য সংকট দেখা যায়। ২২ এপ্রিল ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে তাদের বন্দুক যুদ্ধ হয়। এতে ১২ জন বিপ্লবী কিশোর (যাদের বয়স ছিল ১৩- ১৮ এর মধ্যে) এবং প্রায় ৭০ জন ব্রিটিশ সেনা নিহত হয়। বিপ্লবীরা পুনরায় পিছু হটতে বাধ্য হয়। নিহত ১২ জন শহীদের লাশ আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। বিপ্লবীরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পালিয়ে যান। ব্রিটিশ সরকার ব্যাপক ধড়পাকড় শুরু করে। একে একে সকলেই গ্রেফতার হন অথবা বন্দুক যুদ্ধে শহীদ হন। দীর্ঘদিন পালিয়ে বেড়ানোর পর ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সূর্যসেন গ্রেফতার হন। বিচারে সূর্য সেন ও তার সাথী তারকেশ্বর দস্তিদারকে ফাঁসি এবং বাকিদের আজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ফাঁসি দেয়ার পূর্বে মাস্টারদা সূর্য সেনের উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে তার দাঁত, হাতের কনুই, এবং পায়ের হাঁটু ভেঙে দেয়া হয়। সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের লাশ আত্মীয়দের হাতে হস্তান্তর করা হয়নি এবং হিন্দু সংস্কার অনুযায়ী পোড়ানো হয়নি।ফাঁসীর পর লাশ দুটো জেলখানা থেকে ট্রাকে করে স্টীমার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর মৃতদেহ দুটোকে ব্রিটিশ ক্রুজার “The Renown”-এ তুলে নিয়ে বুকে লোহার টুকরা বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের সংলগ্ন একটি জায়গায় ফেলে দেয়া হয়। সূর্য সেনের এই আত্মত্যাগ সমগ্র ভারত বর্ষে আলোড়ন তোলে। ব্রিটিশদের থেকে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভ বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের মতো এতটা রক্তক্ষয়ী না। এত মানুষের হাহাকারও সেখানে মিশে নেই। এই স্বাধীনতা এসেছে মূলত রাজনৈতিক তর্ক বিতর্কের মাধ্যমে।বলাইবাহুল্য সূর্য সেন কিংবা ভগৎ সিংদের মতো বিপ্লবীদের পিছনে সাধারণ মানুষ দাঁড়াননি, সাধারণ সুবিধাবাদী বাঙালিরা বিপ্লবের সুফল ভোগ করেছেন, কিন্তু তারা নিজেরা সংগ্রামে নামেননি। যদি নামতেন তাহলে হয়তো ব্রিটিশরা আরও অনেক আগেই পালাতে বাধ্য হতো। যাই হোক, খুব সংক্ষেপে চট্টগ্রাম বিপ্লবের ইতিহাসটুকু বলার চেষ্টা করেছি। কারণ কোন বিস্ময়কর কারণে চট্টগ্রাম বিপ্লব নিয়ে আমাদের দেশে তেমন কোন চর্চা নেই। সূর্য সেনকে কি আমরা আমাদের বীর শহীদ মনে করি না? তাকে মনে করি ভারতবর্ষের জন্য জীবন দেয়া একজন বিপ্লবী হিসেবে?চট্টগ্রামে সেই ফাঁসির মঞ্চ, সূর্য সেনের স্মৃতি বিজড়িত স্থান এখনও বিদ্যমান। সূর্য সেনের সম্মাননা বলতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি হলের নামকরণ হয়েছে তার নামে। দিবসভিত্তিক আলোচনা, শ্লোগানে তাদের নাম- এই পর্যন্তই চট্টগ্রাম বিপ্লবীদের নাম সীমাবদ্ধ। তাদের নিয়ে ব্যাপক আকারে গবেষণা, চলচ্চিত্র, আলোচনা এগুলো চোখে পড়ে না। মুক্তিযুদ্ধের উপর বাংলাদেশে অসংখ্য চমৎকার সব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশে চট্টগ্রাম বিপ্লবের উপর এখন অবধি কোন চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি। চট্টগ্রাম বিপ্লব নিয়ে দুটি চলচ্চিত্র হয়েছে ভারতে- Chittagong Movie এবং Khelein Hum Jee Jaan Sey। এর মধ্যে দ্বিতীয় চলচ্চিত্রটিতে অভিষেক, দীপিকার মতো তারকারা রয়েছেন বলে মুভিটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এছাড়া অভিনয়, কাহিনী সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম বিপ্লবকে অনুভব করতে বাধ্য করবে মুভিটি। বলাইবাহুল্য দুটি মুভিই হিন্দিতে। যদিও চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা বাংলাভাষীই ছিলেন তবুও চলচ্চিত্রটি যেহেতু বলিউডের, তাই সেখানে হিন্দিতেই কথা বলেছেন মাস্টার দা-প্রীতিলতারা। মাস্টারদা কি কেবলমাত্র একজন ভারতীয় বিপ্লবী? তিনি ভারতের, আমাদের না? তা নাহলে তাকে নিয়ে আমাদের এই অজ্ঞতা, উন্নাসিকতার কারণ কী? তাকে নিয়ে আমাদের চর্চা কম কেন? আমরা কেবল মাস্টারদা আর প্রীতিলতার নামই জানি, এই বিপ্লবের অন্যান্য নায়ক নির্মল, গণেশ, লোকনাথ, তারকেশ্বর, অনন্তলাল, অম্বিকা চরণ, কল্পনা দত্ত- এই নামগুলোর সাথে কি আমরা পরিচিত? সম্মুখযুদ্ধে নিহত নির্মল সেনকে নিয়ে কি আমরা শ্লোগান দেই- ‘নির্মল সেনের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’? আমরা কি অনুভব করি বিশাল ভারতবর্ষের চট্টগ্রাম থেকে এক স্কুল মাস্টার কেবলমাত্র সাহস আর দেশপ্রেমের উপর ভরসা করে চট্টগ্রামকে স্বশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ৪ দিনের জন্য হলেও স্বাধীন করেছিলেন? কিছু সময়ের জন্য হলেও ক্যান্টনমেন্টে ব্রিটিশ পতাকার স্থলে উড়িয়েছিলেন ভারতের পতাকা? এই সূর্য সেনের রক্তই তো আমাদের ৭১ এর মুক্তিযোদ্ধাদের শরীরে ছিল, আমাদের শরীরেও আছে। তাহলে কি করে আমরা এই বীর সেনানীদের বিস্মৃত হলাম? আমরা ইতিহাস জানব, কেবল সাল তারিখ নয়- বীরত্বের ইতিহাসকে উপলব্ধি করব, অনুভব করব। কোন পরিচালক নিশ্চয়ই বাংলা ভাষায় সেই দিনগুলোকে সেলুলয়েডে তুলে আনবেন, সাহিত্যিক রচনা করবেন কোন অমর উপন্যাস। এই বীরত্বের স্মৃতি আমাদের মাটির। চট্টগ্রামের শহীদদের রক্তেও এই মাটি সিক্ত। তবে কেন তাদের এত অনাদর এখানে? তারা স্বাধীন ভারত বর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন বলে না ‘হিন্দু’ বলে? ইতিহাস যখন বললামই তখন বাকিটুকু বলে শেষ করি। ১৮ এপ্রিলের আক্রমণে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে সূর্য সেনের নির্দেশে এবং সহযোদ্ধাদের হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য প্রীতিলতা ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন। সূর্য সেন এ সম্পর্কে লিখেছেন- “বাংলায় বীর যুবকের আজ অভাব নাই। বালেশ্বর থেকে জালালাবাদ, কালারপোল পর্যন্ত এদের দৃপ্ত অভিযানে দেশের মাটি বারে বারে বীর যুবকের রক্তে সিক্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের জাতিও যে শক্তির খেলায় মেতেছে, ইতিহাসে সে অধ্যায় আজও অলিখিত রয়ে গেছে। মেয়েদের আত্মদানে সে অধ্যায় রচিত হোক এই-ই আমি চাই। ইংরেজ জানুক, বিশ্বজগৎ জানুক, এদেশের মেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধে পেছনে নেই।” ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে প্রীতিলতা সূর্য সেন-এর নির্দেশে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন। হামলায় ৫৩ জন ইংরেজ হতাহত হয়েছিল। গুলিতে আহত প্রীতিলতা দৈহিকভাবে অত্যাচারিত হওয়ার চাইতে থেকে স্বেচ্ছামৃত্যুকে বেছে নেন। তিনি পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। ১২ জানুয়ারি, ১৯৩৪- মাস্টারদা’র মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। সেদিন মাস্টারদা সূর্যসেনের মৃত্যু হলেও, বাংলার আকাশে স্বাধীনতার যে সূর্য তাঁর মাধ্যমে উদিত হয়েছিল, সেই সূর্য ছিল অক্ষয়- অবিনশ্বর।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। গান্ধিজি পালন করছেন অহিংস অহসযোগ আন্দোলন। ভগৎ সিং রা তখন ফাঁসির দড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন। গান্ধীবাদি অহিংস নীতিতে তাদের বিশ্বাস ছিল না অন্যান্য বিপ্লবীদের মতোই। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্র তখন কলকাতা। ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হামলা যখন শুরু করেন বিপ্লবিরা তখন গান্ধী এক বছরের জন্য সেই হামলা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন এবং অহিংস আন্দোলন চালিয়ে যেতে বলেন। গান্ধীর এই এক বছর শেষ হলেও কার্যত অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। এই কথিত এক বছর সময়ের পরও কংগ্রেস অহিংসার নীতিতেই অটল থাকে। আন্দোলনের কেন্দ্র কলকাতায় যা হয়নি,বিশাল ভারত বর্ষের অন্য কোথাও যা হয়নি- এবার তেমন একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত হল বাংলার চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের এক বিদ্যালয়ের অংকের শিক্ষক সূর্য সেনের হাত ধরেই স্বাধীনতার সূর্য ওঠার পথে এক ধাপ অগ্রসর হলো ভারতবর্ষ।
সূর্য সেনের পরিকল্পনা যেকোন দৃষ্টিতেই ছিল ভয়াবহ, বিপজ্জনক এবং আত্মঘাতী। তিনি ও তার সাথীদের পরিকল্পনা ছিল চট্টগ্রামে পুলিশ লাইন, ক্যান্টনমেন্ট, টেলিগ্রাফ অফিস, ইউরোপীয়ান ক্লাব একযোগে আক্রমন করে দখল নেয়া এবং অস্ত্রগার লুঠ করা। চট্টগ্রামকে তিনি ব্রিটিশ মুক্ত করতে চেয়েছিলেন,স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন – যেন তাদের এ পদক্ষেপ সমগ্র ভারত বর্ষে আগুন ছড়িয়ে দেয়। সূর্য সেনের এই মারাত্মক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দরকার ছিল বেশ তরুণ যোদ্ধা। সূর্য সেন তাই এমন কিছু কিশোর বয়সী ছেলেদের কাজে লাগান যাদের মধ্যে ছিল কিছু করার তীব্র ইচ্ছা, ইংরেজদের থেকে দেশ স্বাধীন করার আকাংক্ষা। এই তরুণ দলের মধ্যেই ছিলেন বিনোদ বিহারি চৌধুরী। এই তরুণ দলকে প্রশিক্ষণ দিয়ে মাস্টারদা সূর্য সেন ও তার অন্যান্য বিপ্লবী সহযোদ্ধারা আসন্ন আক্রমনের জন্য প্রস্তুত করে তোলেন। এই দলের সাথেই ছিলেন প্রীতিলতা এবং কল্পনা দত্ত। খুব সূক্ষ্মভাবে পরিকল্পনা করে অবশেষে ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল আক্রমণের দিন ধার্য হয়। কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে বিপ্লবীরা টেলিগ্রাফ অফিস,পুলিশ লাইন, ক্যান্টনমেন্ট আর ইউরোপীয়ান ক্লাবে ছড়িয়ে যান। যথাসময়ে আক্রমণ করা হয়। সূক্ষ্ম পরিকল্পনা থাকলেও দুটি মারাত্মক ভুল করে বসেন তারা।


ইউরোপীয়ান ক্লাব ছিল ইংরেজ দের ক্লাব। রাতে এখানে তারা আড্ডা পার্টি করত প্রতিদিন। বিপ্লবীদের পরিকল্পনা ছিল এখানে আক্রমণ করে সব ইংরেজদের জিম্মি করে ফেলা। অফিসারদেরকে এখানে জিম্মি করে ফেলতে পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে, এটাই ছিল তাদের চিন্তা। কিন্তু আক্রমণের দিন অর্থাৎ ১৮ এপ্রিল ছিল ‘গুড ফ্রাইডে’ অর্থাৎ ঐদিন কোন ইংরেজ ক্লাবে আসেই নি, বিপ্লবীদের একটি দল ইউরোপীয়ান ক্লাব দখল করে দেখেন সেখানে কোন ইংরেজ নেই। ক্যান্টনমেন্ট দখল নিয়ে সেনাদেরকে ব্যারাকেই আটকে ফেলেন বিপ্লবীরা। অস্ত্রাগার লুট করেন এবং দেখেন যে অস্ত্রাগারে কেবল অস্ত্রই পড়ে আছে- নেই কোন কার্তুজগুলি। আর্মি সিক্রেট হিসেবে অস্ত্র আর কার্তুজ এক সাথে রাখা হতো না- যা জানা ছিল না বিপ্লবীদের। অর্থাৎ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র হস্তগত হলেও কার্যত সেগুলো ছিল অচল। বিপ্লবীদের ভরসা ছিল এই অস্ত্রগুলোই। কারণ তাদের কাছে যে অস্ত্র আছে তা ছিল নিতান্ত অপ্রতুল। এর মধ্যে ব্যারাক ভেঙে সৈন্যরা বেড়িয়ে পড়ে-গুলি বিনিময়ের পর বাধ্য হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয় বিপ্লবীরা।
পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তারপরও সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ায় চট্টগ্রাম কার্যত স্বাধীন ছিল ৪ দিন। বিপ্লবীরা আশ্রয় নিয়েছিল জালালাবাদ পাহাড়ে কিন্তু তাদের খাদ্য সংকট দেখা যায়। ২২ এপ্রিল ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে তাদের বন্দুক যুদ্ধ হয়। এতে ১২ জন বিপ্লবী কিশোর (যাদের বয়স ছিল ১৩- ১৮ এর মধ্যে) এবং প্রায় ৭০ জন ব্রিটিশ সেনা নিহত হয়। বিপ্লবীরা পুনরায় পিছু হটতে বাধ্য হয়। নিহত ১২ জন শহীদের লাশ আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। বিপ্লবীরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পালিয়ে যান। ব্রিটিশ সরকার ব্যাপক ধড়পাকড় শুরু করে। একে একে সকলেই গ্রেফতার হন অথবা বন্দুক যুদ্ধে শহীদ হন। দীর্ঘদিন পালিয়ে বেড়ানোর পর ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সূর্যসেন গ্রেফতার হন। বিচারে সূর্য সেন ও তার সাথী তারকেশ্বর দস্তিদারকে ফাঁসি এবং বাকিদের আজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
ফাঁসি দেয়ার পূর্বে মাস্টারদা সূর্য সেনের উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে তার দাঁত, হাতের কনুই, এবং পায়ের হাঁটু ভেঙে দেয়া হয়। সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের লাশ আত্মীয়দের হাতে হস্তান্তর করা হয়নি এবং হিন্দু সংস্কার অনুযায়ী পোড়ানো হয়নি।ফাঁসীর পর লাশ দুটো জেলখানা থেকে ট্রাকে করে স্টীমার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর মৃতদেহ দুটোকে ব্রিটিশ ক্রুজার “The Renown”-এ তুলে নিয়ে বুকে লোহার টুকরা বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের সংলগ্ন একটি জায়গায় ফেলে দেয়া হয়।
সূর্য সেনের এই আত্মত্যাগ সমগ্র ভারত বর্ষে আলোড়ন তোলে। ব্রিটিশদের থেকে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভ বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের মতো এতটা রক্তক্ষয়ী না। এত মানুষের হাহাকারও সেখানে মিশে নেই। এই স্বাধীনতা এসেছে মূলত রাজনৈতিক তর্ক বিতর্কের মাধ্যমে।বলাইবাহুল্য সূর্য সেন কিংবা ভগৎ সিংদের মতো বিপ্লবীদের পিছনে সাধারণ মানুষ দাঁড়াননি, সাধারণ সুবিধাবাদী বাঙালিরা বিপ্লবের সুফল ভোগ করেছেন, কিন্তু তারা নিজেরা সংগ্রামে নামেননি। যদি নামতেন তাহলে হয়তো ব্রিটিশরা আরও অনেক আগেই পালাতে বাধ্য হতো। যাই হোক, খুব সংক্ষেপে চট্টগ্রাম বিপ্লবের ইতিহাসটুকু বলার চেষ্টা করেছি। কারণ কোন বিস্ময়কর কারণে চট্টগ্রাম বিপ্লব নিয়ে আমাদের দেশে তেমন কোন চর্চা নেই। সূর্য সেনকে কি আমরা আমাদের বীর শহীদ মনে করি না? তাকে মনে করি ভারতবর্ষের জন্য জীবন দেয়া একজন বিপ্লবী হিসেবে?চট্টগ্রামে সেই ফাঁসির মঞ্চ, সূর্য সেনের স্মৃতি বিজড়িত স্থান এখনও বিদ্যমান। সূর্য সেনের সম্মাননা বলতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি হলের নামকরণ হয়েছে তার নামে।
দিবসভিত্তিক আলোচনা, শ্লোগানে তাদের নাম- এই পর্যন্তই চট্টগ্রাম বিপ্লবীদের নাম সীমাবদ্ধ। তাদের নিয়ে ব্যাপক আকারে গবেষণা, চলচ্চিত্র, আলোচনা এগুলো চোখে পড়ে না। মুক্তিযুদ্ধের উপর বাংলাদেশে অসংখ্য চমৎকার সব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশে চট্টগ্রাম বিপ্লবের উপর এখন অবধি কোন চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি। চট্টগ্রাম বিপ্লব নিয়ে দুটি চলচ্চিত্র হয়েছে ভারতে- Chittagong Movie এবং Khelein Hum Jee Jaan Sey। এর মধ্যে দ্বিতীয় চলচ্চিত্রটিতে অভিষেক, দীপিকার মতো তারকারা রয়েছেন বলে মুভিটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এছাড়া অভিনয়, কাহিনী সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম বিপ্লবকে অনুভব করতে বাধ্য করবে মুভিটি। বলাইবাহুল্য দুটি মুভিই হিন্দিতে। যদিও চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা বাংলাভাষীই ছিলেন তবুও চলচ্চিত্রটি যেহেতু বলিউডের, তাই সেখানে হিন্দিতেই কথা বলেছেন মাস্টার দা-প্রীতিলতারা।
মাস্টারদা কি কেবলমাত্র একজন ভারতীয় বিপ্লবী? তিনি ভারতের, আমাদের না? তা নাহলে তাকে নিয়ে আমাদের এই অজ্ঞতা, উন্নাসিকতার কারণ কী? তাকে নিয়ে আমাদের চর্চা কম কেন? আমরা কেবল মাস্টারদা আর প্রীতিলতার নামই জানি, এই বিপ্লবের অন্যান্য নায়ক নির্মল, গণেশ, লোকনাথ, তারকেশ্বর, অনন্তলাল, অম্বিকা চরণ, কল্পনা দত্ত- এই নামগুলোর সাথে কি আমরা পরিচিত? সম্মুখযুদ্ধে নিহত নির্মল সেনকে নিয়ে কি আমরা শ্লোগান দেই- ‘নির্মল সেনের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’? আমরা কি অনুভব করি বিশাল ভারতবর্ষের চট্টগ্রাম থেকে এক স্কুল মাস্টার কেবলমাত্র সাহস আর দেশপ্রেমের উপর ভরসা করে চট্টগ্রামকে স্বশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ৪ দিনের জন্য হলেও স্বাধীন করেছিলেন? কিছু সময়ের জন্য হলেও ক্যান্টনমেন্টে ব্রিটিশ পতাকার স্থলে উড়িয়েছিলেন ভারতের পতাকা?
এই সূর্য সেনের রক্তই তো আমাদের ৭১ এর মুক্তিযোদ্ধাদের শরীরে ছিল, আমাদের শরীরেও আছে। তাহলে কি করে আমরা এই বীর সেনানীদের বিস্মৃত হলাম? আমরা ইতিহাস জানব, কেবল সাল তারিখ নয়- বীরত্বের ইতিহাসকে উপলব্ধি করব, অনুভব করব। কোন পরিচালক নিশ্চয়ই বাংলা ভাষায় সেই দিনগুলোকে সেলুলয়েডে তুলে আনবেন, সাহিত্যিক রচনা করবেন কোন অমর উপন্যাস। এই বীরত্বের স্মৃতি আমাদের মাটির। চট্টগ্রামের শহীদদের রক্তেও এই মাটি সিক্ত। তবে কেন তাদের এত অনাদর এখানে? তারা স্বাধীন ভারত বর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন বলে না ‘হিন্দু’ বলে?
ইতিহাস যখন বললামই তখন বাকিটুকু বলে শেষ করি। ১৮ এপ্রিলের আক্রমণে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে সূর্য সেনের নির্দেশে এবং সহযোদ্ধাদের হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য প্রীতিলতা ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন। সূর্য সেন এ সম্পর্কে লিখেছেন-
“বাংলায় বীর যুবকের আজ অভাব নাই। বালেশ্বর থেকে জালালাবাদ, কালারপোল পর্যন্ত এদের দৃপ্ত অভিযানে দেশের মাটি বারে বারে বীর যুবকের রক্তে সিক্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের জাতিও যে শক্তির খেলায় মেতেছে, ইতিহাসে সে অধ্যায় আজও অলিখিত রয়ে গেছে। মেয়েদের আত্মদানে সে অধ্যায় রচিত হোক এই-ই আমি চাই। ইংরেজ জানুক, বিশ্বজগৎ জানুক, এদেশের মেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধে পেছনে নেই।”
২৩ সেপ্টেম্বর রাতে প্রীতিলতা সূর্য সেন-এর নির্দেশে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন। হামলায় ৫৩ জন ইংরেজ হতাহত হয়েছিল। গুলিতে আহত প্রীতিলতা দৈহিকভাবে অত্যাচারিত হওয়ার চাইতে থেকে স্বেচ্ছামৃত্যুকে বেছে নেন। তিনি পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
১২ জানুয়ারি, ১৯৩৪- মাস্টারদা’র মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। সেদিন মাস্টারদা সূর্যসেনের মৃত্যু হলেও, বাংলার আকাশে স্বাধীনতার যে সূর্য তাঁর মাধ্যমে উদিত হয়েছিল, সেই সূর্য ছিল অক্ষয়- অবিনশ্বর।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রাক্ষসী। পর্ব-১

পথযুবক

প্রথম প্রেমপত্র