অনন্ত বিজয়

কড়া নাড়ার পর সন্দেহ নিয়ে কেউ একজন ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করে, কে? রাজীব, আরিফ জানতে চায় অনন্তের দাদা বাড়ি আছেন কিনা। শুনতে পাই তিনি নেই। (যেহেতু আমরা আগে ওইখানেই থাকতাম, সেই সুবাদে অনন্ত দাদার পরিবারের সাথে পুর্ব পরিচিত ছিলাম)তাই ভেতরে যাবার অনুমতি মেলে। আমি বুঝতে পারিনা কী বলা উচিত। এই পরিবারটা ক্লান্ত লোকের সাথে কথা বলে বলে। আমি শুধু অনন্ত'দাদার বাবা আর মায়ের পাশে একটু বসতে চেয়েছিলাম। তবু জিজ্ঞেস করি কেমন আছেন মাসীমা?
উনি কি বিরক্ত হন আমার এই বালখিল্য প্রশ্নে? হন নিশ্চই, উত্তর দেন তবু। "কিলান থাকতাম আমি? আমার ফুয়াটারে মারিলাইলো।"
এরপর কথা বলে যান স্বগোতক্তির মতো। একটা বড় শান্ত ছেলে ছিল তার অনন্ত। বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত অনেক দিন ধরে, মায়ের নিজের অসূস্থ্যতাও অনেক। বাবা মা কে ঔষধ খাইয়ে দিত, ডাক্তারের কাছে নিয়মিত কিংবা অনিয়মিত যাবার সঙ্গীও ছিল সে।
এমনকী সেই শেষ দিনটাতেও টেবিলের ওপর খাবার আর ঔষধ রেখে বলে গেছে "নয়টা সময় ঔষধ খাইলিও মা"। তারপর সেই ঔষধ পড়ে থাকলো টেবিলেই।
অনন্ত'দাদাকে তাড়া করা হয়েছিল যেখান থেকে সেখান থেকে তিনি দৌঁড়ে আসছিলেন বাসার দিকে। পাড়ার পুকুরের কাছে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যান।তার মায়ের কাছে জানতে পারি এই পুকুর ঘিরে কত স্মৃতি তার। এই পাড়ায় জন্ম, আমরা যাকে অনন্ত নামে চিনি পাড়ার লোকে তাকে চিনতো ডাক নামে, রিপন। তবু এলোনা একটা লোকও।
বাসার সবাই তখন ব্যস্ত কাজে যাবার কিংবা নতুন একটা দিন শুরু করতে। কেউ জানেনা একটু দূরে রক্তে ভেসে যাচ্ছে এই বাড়ির ছেলে। একটা ছোট্ট ছেলে শুধু হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খবর দিল "রিপন কাকুরে মারি লার, রিপন কাকুরে মারি লার।"
বোনেরা পাগলের মতো বের হয়ে গেছে। যেই যানবাহন গেছে মিনতি করেছে একবার হাসপাতালে নিয়ে যেতে। তাদের কান্নায় শেষ পর্যন্ত মন গলেছে এক সিএনজি ড্রাইভারের। বোনেরা ধরাধরি করে নিয়ে গেছে তাদের কাটাছেঁড়া ভাইকে।
একটু পরে মা কান্না থামান একটু। রুক্ষ গলায় বলেন,কী হইলো এইসব লেখালেখি করে? কিছু হবে এই দেশের? একটা কিছু পালটাইসে? "কুনোদিন পাইমুনি আমার ফুয়ার মরার বিচার? ওই যে অজয় রায়, কত বড় মানুষ তার ফুয়ারে মারিলাইলো কেউ কিচ্ছু করতো পারলোনা, আমার ফুয়ারে কয়জন চিনে? তুমরা বুঝবায় কিতা?"
আমরা আসলেই কিছু বুঝতে পারিনা। শুধু মায়ের হাত ধরে থাকি এর থেকে বেশি কিছু করার ক্ষমতা নেই বলে। রাজীব বসে থাকে মাথা নীচু করে।
যেই জায়গায় হত্যা হয়েছিলেন অনন্ত, তার ভাই বোন প্রতিদিন কাজে যান এই জায়গার সামনে দিয়ে। আমার চিন্তা করার সাহস হয়না কেমন লাগে তাদের? অনন্ত বিজয় দাদা এবং অনন্ত'দাদার মা, আমাদের এগিয়ে নেয়ার জন্য আপনার ছেলেকে চলে যেতে হলো। আমাদের কখনো ক্ষমা করবেন না।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রাক্ষসী। পর্ব-১

প্রথম প্রেমপত্র

বুঝতে পারা