সন্তান
'সিগারেট চলবে নাকি?'
লোকটা বেনসন অ্যান্ড হেজেস টানছে।অনেক দিন হল বেনসন খাইনা।ভুল বললাম,সিগারেট তো খাওয়া যায়না।পান করতে হয়।চলতি বাংলায় টানতে হয়।একটা বেনসন এখন ১০ টাকা।১০ টাকা বাঁচানোর জন্য এখন আমি অবলীলায় দশ কিলোমিটার হাটতে পারি।সেখানে বেনসন টানা মানে চূড়ান্ত বিলাসীতা।তাই সংকোচ থাকলেও বললাম,'চলবে।'
প্যাকেট বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে,একটা সিগারেট তুলে নিতেই লাইটার টা বাড়িয়ে দিলেন।কত হবে লাইটার টার দাম?বেশ দামি বোঝাই যাচ্ছে।সম্ভবত কেউ উপহার দিয়েছে।এমনিতেই ছেলেদের কে নাকি উপহার দেওয়া ঝামেলা,কি দেয়া যায় এটা নাকি মেয়েরা বুঝতেই পারেনা।সেক্ষেত্রে যারা ধূমপান করে তাদের কে লাইটার উপহার দেয়ার চল আছে।হয়তো যে প্রেমিকা তার প্রেমিক কে সিগারেট খেতে দেখলে রেগে যায়,সেও প্রেমিকের জন্মদিনে দামি লাইটার দিয়ে বলে,"মনে করোনা সিগারেট খেলে আমি কিছু বলব না,এটা পছন্দ হল তাই কিনেছি তোমার জন্য।ভুলেও সিগারেট ধরাবা না।"
সিগারেট ধরিয়ে শান্তি পেলাম।আমি সিগারেট খাওয়া শুরু করেছিলাম এই বেনসন দিয়ে।শৌখিন ধূমপায়ি ছিলাম।নেশায় পেয়ে বসেনি কখনও।ধোয়া না গিলে মুখের ভিতরে রাখার কৌশলটাও শিখে গিয়েছিলাম দ্রুতই।এখন কেউ না সাধলে সিগারেট খাওয়া হয়না।অনেক দিন পর বেনসন টেনে তাই সুখ পাচ্ছিলাম।
'তোমার নামের আগে পিছে কিছু আছে?ডক্টর,প্রফেসর,অ্যাডভোকেট বা এমন কিছু?' লোকটা উত্তর পাওয়ার জন্য প্রশ্নটা করেনি,কিছু একটা বলার জন্য ভূমিকা হিসেবে প্রশ্নটা করেছে।আমি তাই চুপ করে থাকলাম। সেই বলতে থাকল,
'কিন্তু আমার নামের আগে একটা অ্যাডভোকেট আছে।অ্যাডভোকেট গোলাম সারোয়ার।এজন্য মানুষ আমাকে গুরুত্ব দেবে।এই গুরুত্বের ছিটেফোটাও তুমি পাবেনা।'
'জ্বি সেটা আমি জানি।আমাকে গুরুত্ব দেয়ার কোন কারণ নেই।'
'কিন্তু তোমার গুরুত্ব পাওয়া উচিত।তোমার সেই মেধা আছে।রফিক আমাকে বলেছিল।এরপর আমি নিজেই পড়ে দেখেছি। তোমার লেখায় ঝাঝ আছে।এটাই আমি চাচ্ছিলাম।'
আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম।ওনার কথা শেষ হয়নি।তাই অপেক্ষা করাই শ্রেয়।
'দেখ তুমি হয়তো ভাবছ এটা আমি কেন করছি?বুঝিয়ে বলছি শোন।আমি একজন অ্যাডভোকেট।আমার বর্তমান অবস্থা খুব একটা খারাপ না।আমি পত্র পত্রিকায় কোন কলাম দিলে পত্রিকা গুলো সেটা ছাপবে।লেখা যদি মানুষ কে আকৃষ্ট করে তাহলে আমার নাম হবে।টেলিভিশন টক-শো গুলোতেও ডাক পড়বে।আমার প্রসার আরও বাড়বে।বলতে পার এটা একরকম অ্যাডভার্টাইসমেন্ট।বিভিন্ন কোম্পানি যেমন তাদের বিজ্ঞাপনের জন্য অ্যাড ফার্মের কাছে যায়,তুমিও তেমনি আমার অ্যাড ফার্ম।'
লোকটার কথায় আমার বিরক্তি বাড়ছিল।কিন্তু চুপ করে শোনা ছাড়া কিছু করার নেই।আমি নিজের প্রয়োজনেই তার কাছে এসেছি।এই লোকের খোজ আমাকে দিয়েছিল রফিক।একটা টিউশনির খুব দরকার ।একটি টিউশনি যদিও আছে তবে তাতে পোষাচ্ছে না। এদিকে খরচ বাড়ছে হু হু করে।আরেকটা টিউশনি পেলে অবস্থা কিছুটা সামাল দেয়া যেত।রফিক কে বলেছিলাম একটা টিউশনি যোগাড় করে দিতে। রফিক বলেছিল, 'তুই তো ভাল লেখিস।টিউশনি করে যা পাবি,লিখে এর থেকে ঢের বেশি কামাতে পারবি।'
আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম ঐ কথাটুকু শুনেই।কাউকে না বললেও আমি মনে মনে যে লেখক হবারই স্বপ্ন দেখি।বেশ কিছু পত্রিকায় লেখা পাঠালেও তারা কেউ ছাপেনি এখন পর্যন্ত।কয়েকটা অনলাইন পোর্টাল কিছু লেখা প্রকাশ করেছিল,কিন্তু সেগুলোতে কি আর মন ভরে?ফেসবুক ব্লগে পাঠক আছে,তাদের প্রশংসাও পাওয়া যায় কিন্তু ছাপার অক্ষরে নিজের নাম,নিজের লেখা দেখার মধ্যে আলাদা মাদকতা আছে।সেই ছোটবেলায় যখন স্কুলের ম্যাগাজিনে কবিতা ছাপা হল প্রথম তখন মনে হয়েছিল স্বর্গ পেয়ে গেছি।বাসায় যেই আসতো তাকেই ম্যাগাজিনটা দেখাতাম।ঐ স্কুলে ম্যাগাজিনেই এরপর কিছু কবিতা,গল্প ছাপা হয়েছে।এরপর আর কোথাও ছাপার অক্ষরে নিজের লেখা দেখার সৌভাগ্য হয়নি।
রফিকের যে যোগাযোগ আছে তা তো জানতাম না।তবে নিজের লেখা যদি প্রকাশ পায় আর কিছু টাকাও পাওয়া যায় তাতে মন্দ কি।বরং স্বপ্ন পূরণের পথে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া যাবে!রফিক কে জিজ্ঞেস করলাম,'কিভাবে?আমার লেখা কে ছাপবে?আর টাকাই বা কেন দেবে?আর কতই বা দেবে?'
'তোর লেখা ছাপবে কিন্তু তোর লেখা ছাপবে না।'
'হেয়ালি করিস না।ক্লিয়ার করে বল।'
'রাগ করছিস কেন?তোকে সারোয়ার ভাই এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেব।ভাই তোর মত একজন লেখক খুজছে।যার লেখায় ঝাঁজ আছে,প্রতিবাদী আবার বিশ্লেষণধর্মী।তুই তো আবার গল্প কবিতাও লেখিস।এর আগে কয়েকজনের লেখা পড়ে উনি বাতিল করে দিয়েছেন।তোরটা পছন্দ হবে বলে মনে হয়।'
'উনি কোন পত্রিকার সম্পাদক?'
'আরে ধুর,সম্পাদক কেন হবে?উনি হলেন উকিল।'
আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম না।চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে রফিকের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।রফিক বলল,
'বুঝতে পারছিস না?সারোয়ার ভাই উকিল মানুষ।আস্তে আস্তে ভাল নাম হচ্ছে।উনি এখন পত্র পত্রিকায় কলাম লিখতে চান।এতে একটা পরিচিতি হবে,প্রসারও বাড়বে।আবার টিভি টকশো তেও ডাক পড়তে পারে।কিন্তু বেচারা নিজে সেভাবে লিখতে পারেন না।যদিও সেটা স্বীকার করেন না,বলেন সময় পাইনা!তাই তিনি এমন একজন কে খুজছেন যে তার হয়ে সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে লিখে দেবে,ওনার নামে সেটা ছাপা হবে।লেখা প্রতি তোকে পারিশ্রমিকও দেবে।ভেবে দেখ,তোর লেখাও ছাপা হচ্ছে টাকাও পাচ্ছিস।এমনি তোর লেখা কে ছাপবে?আর ফেসবুকে লিখে কি পাচ্ছিস?তোর টাকার দরকার তাই বললাম।'
'উনি লেখা দিলেই সেটা ছাপা হবে এমন কোন কথা আছে?'
'আরে ওনার পরিচিত লোকজন আছে।সেটা কোন সমস্যা না।আর উনি চাচ্ছেন মান সম্মত লেখা।একটু আলাদা ধরনের যাতে নজরে আসা যায়।'
'কিন্তু আমার লেখা আমি অন্যের নামে ছাপতে দিব কেন?'
'আজব মানুষ তো তুই।তোর এখন টাকার দরকার।কে কোথায় কি করলো তা দিয়ে তোর কাজ কি?তুই টাকা পেলেই তো হল।তোদের এই লেখক দের আমি বুঝিনা,এক দু লাইন কপি করলেও মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়!'
রফিকের কথা গুলো ভেবে দেখলাম।নেতাদের ভাষণও তো অন্যেরা লিখে দেয়,নাম হয় নেতার।মনের ভিতর খচখচানি থাকলেও রফিক এর থেকে ঠিকানাটা নিয়ে নিলাম।এখন এই লোকটা আমাকে অ্যাডফার্ম হিসেবে ভাবছে।লোকটা বলে চলল,
'দেখ আমি বুঝতে পারছি তোমার দ্বিধা টা কোথায়।একজন লেখক স্বীকৃতি চায়।তোমার লেখা আরেকজনের নামে প্রকাশ পাচ্ছে,এটা তুমি মেনে নিতে পারছনা তাই তো?রফিকের কাছে শুনলাম তোমার টাকা পয়সার সমস্যা চলছে?'
আমি মাথা নাড়লাম।তিনি বললেন,
'তোমারও উপকার হবে,আমিও যদি একটু প্রচার-প্রাসার পাই আর কি।তবে ভাই লেখার মান ভাল রেখ।লেখার মানের উপর ঠিক করে লেখা প্রতি তোমাকে আমি ২০০-৫০০ টাকা করে দেব।ভেবে দেখ।আর হ্যা,শুনেছি তুমি ভাল গল্পও লেখ।সামনের বই মেলায় একটা গল্পের বই বেড় করতে চাচ্ছি।গল্প গুলো তুমি লিখে দিতে পারবে তো?চিন্তা করোনা গল্পের জন্য আরও বেশি পাবে।'
আমি আসলে বুঝতে পারছিলাম না কি করব।টাকা আমার খুব দরকার।কিন্তু নিজের লেখা এভাবে বিক্রি করতে কোথায় যেন বাধছিল।আমি চুপ দেখে লোকটা কিছুটা বিরক্ত হলেন,বললেন, "আরে ভাই টাকার জন্য মা সন্তান পর্যন্ত বিক্রি করে দেয়,আর তুমি ছাইপাশ লেখা নিয়ে ভাবছ?"
আমি চমকে উঠলাম।উনি বললেন,' কি বিশ্বাস হলনা তো?আজকের পেপার পড়েছ?এই যে দেখ - "সন্তান কে বিক্রি করে দেয়ার পর ফেরত চাইছেন মা" - পড়ে দেখ।'
আমি পত্রিকাটা হাতে নিলাম।
"সন্তান কে বিক্রি করে দেয়ার পর ফেরত চাইছেন মা!
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ মাত্র ১ লাখ টাকার বিনিময়ে নিজের দু বছর বয়সি শিশু সন্তান কে বিক্রি করে দেয়ার পর এখন পুণরায় সন্তান কে দাবি করছেন মা।ঘটনাটি ঘটেছে বরিশালের পিরোজপুরে।পারিবারিক সুত্রে জানা যায়,অভাবের তারণায় ঘূর্ণিঝড় আইলার পর এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছে নিজের দু বছর বয়সি সন্তান কে বিক্রি করে দিয়েছিলেন বিলকিস বানু নামে এই মহিলা।সন্তান কে বাচাতে এবং অভাবের তাড়নায় এই কাজ করেছিলেন বলে দাবি করছেন তিনি। সন্তানের সাথে দেখা করতে গেলে তাকে দেখা করতে দেয়া হয়না বলে জানান তিনি।সন্তান কে আবার নিজের কাছে ফেরত চান বিলকিস বানু।ঐ দম্পতির সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলতে চান নি তারা।তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক। "
পত্রিকার কোণে ছোট করে ছাপা এই খবরটি সহজে চোখে পড়ার কথা নয়।আমার পড়া শেষ হতেই বিজয়ীর ভঙ্গিতে হেসে উঠলেন অ্যাডভোকেট গোলাম সারোয়ার।বললেন,
'কি বুঝলে?ঐ মহিলা ঐ সময় ঠিকই করেছিল।না হলে বাচ্চাটাকেও বাচাতে পারতনা।এখন বাচ্চাটা ভাল ঘরে আছে,উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।মহিলাও কিছু টাকা পেল।আরে আর কিছু না বুঝলে,আরও কিছু টাকা বাগানোর ধান্দা।'
আমি সেই মায়ের কথা চিন্তা করছিলাম।কোন পরিস্থিতিতে একজন মা তার সন্তান কে বিক্রি করে দিতে পারে?পরক্ষনেই ডাস্টবিনে পাওয়া সেই শিশু গুলোর কথা মনে হল,যাদের কে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পাওয়া যায় মৃত ।কোন প্রেমিক যুগলের ক্ষনিকের আনন্দ ও ভুলের ফসল।তাকে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বাচতে চেয়েছিল হয়তো ওর পিতা মাতা।এদের কে কি পিতা মাতা বলা যায়?
'কি ব্যাপার ভাই,তুমি কি কথা বলবেনা বলে ঠিক করে এসেছ?তো কাজ শুরু করে দাও।আপাতত কারেন্ট কোন ইস্যু নিয়ে লেখ।হরতাল অবরোধ এখন হট কেক।এটা নিয়ে লিখতে পার।পাবলিক সেন্টিমেন্টে যেন লাগে এমন ভাবে লিখবে।সরকারের একটু সমালোচনা করলে পাবলিক খাবে ভাল।মাঝামাঝি একটা জায়গায় থাকবে।দুই দল কেই ধুয়ে দেবে পারলে বুঝলে?তোমার লেখার ধার আছে।তুমি পারবে।কালকেই লেখা দাও।আর গল্প লিখতে থাক,এটা নিয়ে পরে বসব।তবে এই কথাই থাকল?'
'না দুঃখিত।আমার পক্ষে সম্ভব নয়।'
'সম্ভব নয় মানে।মামদোবাজি করছ আমার সাথে?'
'মাফ করবেন।আমি পারছিনা।'
'ফাজলামো করছ তুমি আমার সাথে?এতক্ষন কথা বলে,আমার সময় নষ্ট করে এখন বলছ পারব না!'
'দেখুন চেচাবেন না।আপনার সময় নষ্ট করার জন্য সরি।অন্য কাউকে খুজে নিন।আমি পারবনা।'
অ্যাডভোকেট সাহেবের ঘর থেকে বের হয়ে একটা শান্তি পাচ্ছিলাম।একটা সিগারেট ধরাতে পারলে মন্দ হতনা।কিন্তু পকেটে টাকা নেই।মোবাইল বাজছে।নিশ্চয়ই রফিক।
'হ্যা রফিক বল।'
'শালা তুই এটা কি করছিস?পারবি না আগে বললেই পারতি।সারোয়ার ভাই এর সামনে আমারে বেইজ্জতি করলি কেন?'
'দ্বিধার মধ্যে ছিলাম।'
'তোকে শালা সামনে পেলে দ্বিধা তোর ইয়ে তে দিতাম।'
'আহা এত রাগছিস কেন?দেখ এই কাজ আমি পারব না।মা কখনও নিজের সন্তান কে বেচতে পারেনা।ঘোরের মধ্যে বেঁচে দিলেও পরে আজীবন কাদতে বাধ্য।'
'এখানে মা সন্তান আসলো কোথা থেকে?'
'তুই বুঝবি না।লেখালেখি করলে বুঝতি।'
আমি লাইন কেটে দিলাম।বাসে যাওয়ার থেকে হেটে যাওয়াই ভাল।বাসার দিকে পা বাড়ালাম।হাটতে ভালই লাগছে,টাকাও বেঁচে যাচ্ছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন