১২-বছর পরে

প্রিন্সেপ ঘাটে গঙ্গার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল আরিফ আর মাইশা। বিকাল হয়ে গেছে,রোদটাও এখন মরা। মাইশা দূরের বিদ‍্যাসাগর সেতুর দিকে তাকিয়ে ছিল। সেখানেও তখন শেষ বিকালের আলো খেলা করছে। একটু পরেই আলোয় সেজে উঠবে বঙ্কিম সেতু। গঙ্গার স্রোত তখন নিজের জলে সূর্যের শেষ আলোটুকু শুষে নিচ্ছে। মাইশা এতক্ষণ আকাশ দেখছিল, এবার ওই জলের দিকে তাকাল।

আরিফ ততক্ষণে একটা ঠোঙায় করে ঘটিগরম নিয়ে এসেছে। ঠোঙাটা মাইশার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,'খেয়ে দেখো। এখনও সেই আগের মতই আছে।' মাইশা আরিফের দিকে তাকাল। আরিফ ঠোঙাটা বাড়িয়ে আছে, কালকের বৃষ্টিটার পর থেকে আবার বেশ একটু শীতশীত মত পড়ছে। আরিফের গায়ে একটা হালকা গরম হাফজ‍্যাকেট, মাইশা শুধুই একটা শাড়ি পরে এসেছে। গঙ্গার ঠান্ডা হাওয়ায় ওর বেশ একটু শীতশীত মত করছিল। আরিফের থেকে হাত বাড়িয়ে মাইশা ঘটিগরম কিছুটা নিল। আরিফ হেসে বলল,'আজ কিন্তু বেশ শীত পড়েছে, যাই বলো।' মাইশা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,'হ‍্যাঁ। কালকের বৃষ্টিটার পর থেকে বেশ শীত পড়েছে।'
হাসলে মাইশার সুন্দর ফোলা গালটার বাঁ দিকে এখনো সুন্দর একটা টোল পড়ে খেয়াল করল আরিফ। সেই আগের মতোই !

একটু সামনেই তখন মাইশার বছর সাতেকের মেয়ে দীপান্বিতা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গঙ্গায় লঞ্চের চলাফেরা দেখছিল। এবার ঘটিগরম দেখেই সে ফিরে এসে মার কাছে হাত পাতল। মাইশা কিছুটা ওর হাতে দিল। কম হয়ে যাওয়ায় ঠিক মন ভরল না দীপান্বিতার। দৌড়ে আরিফের কাছে এসে বলল,'আঙ্কেল ! মা দিচ্ছে না আর। আমায় আরেকটু দাও না।'
আরিফ একটু হেসে ওর হাতে আরো কিছুটা ঘটিগরম দিল। এবার দীপান্বিতা খুশি হল। মার দিকে তাকিয়ে একটা ভেংচি কেটে আবার আগের যায়গায় ফিরে গিয়ে লঞ্চ দেখতে লাগল।
আরিফ একটু এগিয়ে গেল। মাইশা এখনো একমনে গঙ্গা দেখে যাচ্ছে। আরিফ ওর কাছাকাছি গিয়ে ওর চোখে চোখ রাখল। মাইশা সামনে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে থাকলেও ওর দৃষ্টি যেন পৌছে গেছে সেই বহুদূরে,আশুতোষ কলেজের সেই দিনগুলোয়....

আরিফ আস্তে করে ডাকল,'মাইশা'।
মাইশা একটু চমকে উঠে ওর দিকে ফিরে তাকাল, আবার গঙ্গার দিকে তাকাল। আস্তে আস্তে বলল,'আরিফ,সেদিনও এরকম শীত পড়েছিল না আমরা যেদিন প্রিন্সেপ ঘাটে এসেছিলাম ? তুমি একটা কালো হাফ জ‍্যাকেট পরেছিলে। আমার শীত করছিল বলে ওটা খুলে আমাকে পরিয়ে দিয়েছিল।'
আরিফ ম্লান হেসে বলল,'মনে আছে দেখছি।'
মাইশাও একটু হাসল। সে হাসিতে উচ্ছাস নেই। আস্তে করে বলল,'তারপর কি হল আরিফ? সব কিছু অন‍্যরকম হয়ে গেল না! কি ভেবেছিলাম আমরা! আর কি হল!
আরিফ বড় করে একটা নিশ্বাস ছাড়ল, মাথাটা একটু নিচু করে জলের দিকে তাকাল।
মাইশা আবার বলল,'তুমি তো লেখক মানুষ। এত তো সুন্দর সুন্দর প্রেমের গল্প লেখ, কত সম্পর্ক আঁতশকাচ দিয়ে দেখো। একেই বোধহয়
ভাগ‍্য বলে, তাই না ?'
আরিফ মৃদুস্বরে বলল,'থাক না! যা হওয়ার হয়ে গেছে। এতবছর পরে আবার পুরনো কথা...'
মাইশা হাসল আস্তে করে। বলল,'সেই। কি আর হবে মনে করে !'

তখন আরো অন্ধকার নেমে আসছে চারপাশে। মাইশা হাতঘড়ির দিকে একবার তাকাল, প্রায় ৬ বাজতে যাচ্ছে।
আরিফকে বলল,'আজ আসি! প্রায় ৬ বাজল।
শিহাবের ফেরার সময় হয়ে যাচ্ছে, তুমি আমাদের একটা ট‍্যাক্সি ধরিয়ে দাও।'
মাইশা সামনে এগিয়ে গেল দীপান্বিতাকে ডেকে আনতে।
আরিফ এবার গঙ্গার জলের দিকে তাকাল,
গঙ্গার জলে তখন ভীষণ মৃদু একটা সূর্যের আলো দেখা যাচ্ছে! আরিফের মনে হল গঙ্গার জলটা ভীষণ অভিজ্ঞ, জলে সূর্যের মৃদু আলোটাও আরিফের দিকে তাকিয়ে যেন একটা মলিন হাসি হাসছে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রাক্ষসী। পর্ব-১

প্রথম প্রেমপত্র

বুঝতে পারা