আকাশগঙ্গা (পর্ব-৩)
আকাশের মায়ের দাদু মারা যায়। সেই উদ্দেশ্যে তারা গ্রামে যাচ্ছে। আকাশ, তার বাবা-মা, তার দুই খালা, দুই মামা এবং তাদের পরিবারসহ। মৃত ব্যাক্তিকে নিয়ে কারো তেমন কোন মাথা ব্যাথা নেই। আবেগও নেই। শুধুমাত্র আকাশের মা এবং তার খালা কিছু সময় পর পর স্মৃতিচারন করে কেঁদে উঠছেন। সেই কান্নাও খুব ক্ষণস্থায়ী এবং কমজোর। এতটুকু না কাঁদলে মৃত ব্যাক্তিকে দেখতে যাচ্ছেন কেউ বলবে না। বরং উৎসব বলে মনে হবে। এখনো উৎসবের চাইতে কম কিছু মনে হচ্ছে না। সবার ছোট বাচ্চা কাচ্চা গুলো খেলাধুলায় ব্যস্ত। বয়স্ক এবং মধ্যবয়স্ক পুরুষেরা রাজনৈতিক আলোচনায় ব্যস্ত। এইরকম একটা উৎসবমুখর পরিবেশে আকাশের মা আর খালার কাঁদাকাটি একেবারে বেমানান ঠেকছে। তারা নিজেরাও সেটা বুঝতে পেরে এখন শান্ত হয়েছেন। তাদের আবেগকে কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না। কান্নাকে গুরুত্ব না দেয়া হলে সেটা মূল্যহীন। সেই কান্না কেঁদে কোন লাভ হয় না।
ওদিকে গঙ্গা গ্রামে যাচ্ছিল তার বান্ধুবির বিয়ে খাওয়ার জন্যে। গঙ্গা যখন ৯ এ পরত তখন তারা গ্রাম থেকে ঢাকা চলে আসে। এর মাঝে দুইবার তাদের গ্রামে যাওয়া হয়েছিল। শেষ গ্রামে গিয়েছিল ৪ বছর আগে। গঙ্গাদের গ্রামের নাম ছিল মধুকূপী। লঞ্চের ছাদে দাঁড়িয়ে গঙ্গা চারিপাশের প্রকৃতিটাকে দেখছিল। চারিপাশে শুধু জল আর জল। তার মাঝে চাঁদের আলোর বিচ্ছুরণ গুলোকে ফেইনম্যান ডায়াগ্রামের মতন মনে হচ্ছিল। লঞ্চের মেশিনের পানি কাটার ছল ছল শব্দে গঙ্গা তার জীবনের বিশাল কাব্যের মাঝে হাবুডুবু খায়। গ্রাম থেকে চলে এসে নতুন একটা পরিবেশ বসবাস করা তার জীবনের মাঝে বিশাল একটা প্রভাব রেখেছে। গ্রামের মানুষগুলোর সাথে সম্পর্ক মিশিয়ে দিয়ে শহরের জীবনে মানিয়ে উঠতে তার বেশ কষ্ট হয়েছে। গ্রামে থাকার সময়ে গঙ্গার সাথে তার স্কুলেরই এক সমবয়সী ছেলের সাথে ভাব হয়। সেই ভাব বন্ধুত্ব পর্যন্ত গড়ায়। তারা দুজন আরো কাছাকাছি আসতে থাকে। বন্ধুত্বর সম্পর্ক ছাড়িয়ে তারা ভাই-বোনের মতন একে অপরকে আপন ভাবতে শুরু করে। কিন্তু গঙ্গা আর তার সেই সমবয়সী বন্ধু মামুনের উঠতি বয়সে তাদের কারো সাথেই নিজেদের বিপরীত লিঙ্গের অন্য কারো সাথে সম্পর্ক ছিল না। তাই সুপার ইগোর অনুশাসনের ছদ্মনামী ভাই-বোন সম্পর্কটা বেশিদিন টিকতে পারে নি। সেটা প্রেম- ভালবাসায় গড়ায়। চারিপাশের পরিবেশটা আরো বেশি শীতল আর অন্ধকার হয়ে আসতে থাকে। দুটো মানুষ আরো কাছাকাছি আসে। আর কোন একসময় প্রকৃতি তাদের আলাদা করে দেয়। এরপরে গঙ্গা দুইবার গ্রামে আসে কিন্তু মামুনের সাথে তার দেখা হয় না। মামুন এরপর আর বেশি কিছু পড়াশুনা করে নি। প্রেমবিচ্ছেদ যে তাকে পড়াশুনা থেকে দূরে সরিয়েছে তা কোনভাবেই বলা যাবে না। সে কোনকালেই এই বিষয়ে খুব সতর্ক ছিল না। গঙ্গা ফ্ল্যাশব্যাকে নিজের আর মামুনের জীবনটার তুলনা করে। মামুন গ্রামের আড়তে বসে। জীবন তার সেই চক্রেই আবদ্ধ। আর গঙ্গা গ্রাম ছেড়ে সেই মহানগরী ঢাকার বুকে নিজের জীবন নিয়ে ব্যাতিব্যস্ততায় আবদ্ধ। ঢাকার জীবনও তার খুব শীঘ্রই শেষ হতে চলেছে। এরপরের যাত্রাটা দেশের বাইরে, সেই সুদূর আমেরিকায়। ইউনিভার্সিটি অফ পেনিসিলভেনিয়ায়। মামুন কি কখনো কাউকে বলবে যে, সে যেই মেয়েটার সাথে প্রেম করত সে ইউনিভার্সিটি অফ পেনিসিলভেনিয়ায় আন্ডারগেজুয়েট করেছিল। সে কি জানে এর গুরুত্ব?? জানলেও কী তার পুরুষালী ইগো এর গুরুত্ব বুঝতে চাইবে? এই কমবেশির হিসেবে গঙ্গা জিততে পেরেও খুব একটা খুশি হয় নি। তার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা পানি গড়াতে থাকে। নদীর বাতাসে সেই ফোঁটাটুকু খুব দ্রুত শুকিয়েও যায়।
(সমাপ্ত)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন